3:25 pm , July 26, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ দেশব্যাপী আলোচিত বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যাকান্ডের এক মাস পার হয়েছে। গত ২৬ জুন বুধবার সকাল ১০টা নাগাদ নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীরা বরগুনা কলেজের সামনে তাকে এলোপাতারী কুপিয়ে জখম করে। একই দিন বিকাল সোয়া ৪টায় বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
এদিকে রিফাত হত্যাকান্ডের এক মাস পূর্ণ হলেও এখন পর্যন্ত এজাহারভুক্ত সকল আসামীদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। মামলার প্রধান সাক্ষী নিহতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি সহ এ পর্যন্ত ১৫ জন গ্রেফতার হয়েছে। তবে আত্মগোপনে রয়েছে এজাহারভুক্ত আরো চার আসামী।
তাছাড়া রিফাত হত্যা মামলার তদন্তে অগ্রগতি থাকলেও কবে নাগাদ এই মামলার চার্জশীট আদালতে যাবে সে বিষয়টিও স্পষ্ট করছে না পুলিশ। তবে কোন প্রকার অবহেলা বা কালক্ষেপণ না করে যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত শেষে করে চার্জশীট দাখিলের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন।
এর আগে মাদক সংক্রান্ত বিরোধ ও ব্যক্তি আক্রসকে কেন্দ্র করে গত ২৬ জুলাই হামলা হয় বরগুনা সরকারি কলেজের ছাত্র ও ‘০০৭ গ্রুপের’ এক সময়ের সক্রিয় সদস্য রিফাত শরীফ এর উপর। এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী নয়ন বন্ড, রিফাত ও রিশান ফরাজী এবং তাদের সহযোগিরা রিফাতকে কলেজের ভেতর থেকে ধরে নিয়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম করে। তখন সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্রের সামনে দাড়িয়ে স্বামীকে বাচানোর চেষ্টা করে আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি।
তবে তাতেও শেষ রক্ষা করা যায়নি। রিফাতকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও বিকাল সোয়া ৪টায় অপারেশন টেবিলে তার মৃত্যু হয়। রাতেই এই ঘটনায় নিহত রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে বরগুনা সদর থানায় ১২ জনকে নামধারী এবং অজ্ঞাতনামা ৪/৫ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেন। এ মামলার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে প্রধান সাক্ষী করা হয়েছিলো রিফাতের স্ত্রী মিন্নিকে।
এদিকে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে জখম এবং তাকে বাচাতে স্ত্রী মিন্নি’র ব্যর্থ চেষ্টার একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে দেশ জুড়ে আলোচনার সৃষ্টি হয়। দাবী তোলা সহ হামলাকারী বন্ড বাহিনীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ দেন আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে।
ঘটনার প্রথম দিকে পুলিশের রহস্যজনক নিরবতা থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনার পর নড়েচড়ে বসে বরগুনা জেলা পুলিশ। শুরু হয় তাদের অভিযান। ঘটনার রাতেই বরগুনা সদর থানা পুলিশ গ্রেফতার করেন ৩ আসামীকে। এর পর পর্যায়ক্রমে এজাহারভুক্ত সাত জন, ভিডিও ফুটেজ ও জড়িত সন্দেহের আরো ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
শুধু তাই নয়, হত্যাকান্ডের ৭ দিনের মাথায় পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ‘০০৭ গ্রুপ ও বন্ড বাহিনীর প্রধান সন্ত্রাসী নয়ন বন্ড। তাছাড়া খুনের ঘটনার ১৯ দিনের মাথায় গ্রেফতার দেখানো হয় হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। রিফাত হত্যার প্রথম ভিডিও’র পরে আরো দুটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ভিডিও থেকেই স্বামী রিফাত শরীফকে হত্যার পরিকল্পনার সাথে জড়িত রয়েছে বলে আলোচনায় উঠে আসেন মিন্নি। তাই তাকে হত্যাকান্ডের ১৯ দিনের মাথায় সকালে বরগুনা পৌর এলাকার নিজ বাড়ি থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ লাইন্সএ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পরে রাত ৯টার দিকে মিন্নিকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এমনকি মিন্নি হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এর পাশাপাশি রিফাত ফরাজী ও টিকটক হৃদয় জবানবন্দিতে হত্যাকান্ডের সাথে মিন্নি’র জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ করে।
রিফাত হত্যা মামলার তদন্তের সাথে জড়িত বরগুনা জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হত্যাকান্ডের সাথে মিন্নি’র জড়িত থাকার বিষয়টি পুলিশের কাছে পুরোটাই স্পষ্ট। কেননা তার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে সকল তথ্য প্রমান পুলিশের কাছে এসে পড়েছে। যার মধ্যে বড় একটি আলোমত হলো নয়ন ও মিন্নি’র ঘনিষ্টমূহুর্তের একটি ভিডিও ক্লিপ। যদিও ওই ভিডিওতে নয়নের বিষয়টি নিশ্চিত হলেও মেয়েটি মিন্নি কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
পুলিশের সূত্রটি জানায়, মিন্নি নয়ন বন্ডের সাথে বিয়ের বিষয়টি জোড় দিয়ে অস্বীকার করে চলেছে। তাই নয়ন বন্ডের বাড়ি থেকে জব্দকৃত কিছু আলামত পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য ঢাকায় সিআইডি’র ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। যার মধ্যে মেয়েদের একটি কামিজ, একটি চিরুণী, শামুকে খোদাই করে ‘এন+এম লেখা একটি শামুক, নয়ন ও মিন্নি’র একটি ছবি, পাউডার ও পাউটারের টিউবের লেভেল, মোবাইল, কয়েকটি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস সহ বেশ কিছু আলামত রয়েছে। সিআইডি’র প্রতিবেদন পেলে বাকিটা পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
রিফাত হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বরগুনা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হুমায়ুন কবির বলেন, গত এক মাসে রিফাত হত্যা মামলার তদন্তে অনেকটাই অগ্রগতী হয়েছে। হত্যার রহস্য উদঘাটন ছাড়াও এরই মধ্যে ১৫ জন আসামীকে আমরা গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। যারা সাবাই স্বীকারক্তিমুলক জবানবন্দি দিয়েছে। তবে কবে নাগাদ এ মামলার চার্জশীট দেয়া যাবে সে বিষয়টি এখনো নিশ্চিত না হলেও যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত শেষ করে চার্জশীট জমা দেয়ার কথা বলেন তিনি।
তদন্ত কর্মকর্তা আরো বলেন, এজাহারভুক্ত ৪ জন আসামী এখনো আত্মগোপনে রয়েছে। তাদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যহত রয়েছে। তারা পালিয়ে যেতে পারবে না। চার্জশীট দাখিলের আগেই খুব দ্রুত তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
অপরদিকে বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন বলেন, রিফাত হত্যা মামলাটি একটি স্পর্শকাতর মামলা। তাই খুব দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে সর্তকভাবে মামলার তদন্ত করা হচ্ছে। এজন্য কিছুটা সময় লাগতে পারে। তবে তা বেশিদিন নয়। কবে নাগাদ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে যাবে সে বিষয়টি স্পষ্ট করতে অপরাগতা প্রকাশ করে পুলিশ সুপার বলেন, যত দ্রুত সম্ভব এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হবে।