3:18 pm , June 27, 2019
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ ‘কচু গাছ কাটতে কাটতে ডাকাত’ বনে যাওয়ার মতো ছিচকে চুরি আর ছিনতাইয়ের মধ্য দিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসীতে পরিনত হয়েছে বরগুনার আলোচিত ডিস ব্যবসায়ী যুবলীগ কর্মী শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফ হত্যাকারী সাব্বির হোসেন নয়ন। দলীয় কোন পদ-পদবী না থাকলেও সরকারী দলের ছত্রছায়ায় থেকে ছিচকে চোর থেকে বরগুনার শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীতে পরিনত হয়েছে সে। মাদক বিক্রির পাশাপাশি পৌর শহরের বিকেবি রোডের ধানসিড়ি এলাকার নিজ বাসায় মাদকসেবীদের মাদক সেবনের সুযোগও করে দিত সে। সুবিধা পাওয়ায় মাদকসেবীরাও যায় তার কাছে। এভাবে ধীরে ধীরে বরগুনা শহরের মাদকের ডন বনে যায় সে। নিজের বাসা মাদকের আখড়ায় পরিনত করে সে। প্রায় এক বছর আগে তার ওই বাসা থেকে অন্তত ১৫ লাখ টাকা মূল্যের ইয়াবা এবং দেশী ধারালো অস্ত্র সহ সাব্বির হোসেন নয়নকে গ্রেফতার করে বরগুনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু কিছুদিন পরই জামিনে ছাড়া পেয়ে ফের মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে সে। মাদক ব্যবসার পাশাপাশি এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য একটি বিশাল বাহিনী গড়ে তোলে সে। এই বাহিনী মাদক বিক্রি সহ এলাকায় চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজী সহ নানা অপকর্মে জড়িত। কোন রাজনৈতিক পদে না থেকেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সাথে চলাফেরা করায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে নয়ন। এরই ধারাবাহিকতায় গত বুধবার প্রকাশ্য দিবালোকে যুবলীগ কর্মী ডিস ব্যবসায়ী শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করে নয়ন ও তার সহযোগীরা। দূর থেকে এই দৃশ্য কে বা কারা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। নয়নের কোপানোর দৃশ্য দেখলে যে কেউ আতকে যাবেন, শরীর শিহরে উঠবে।
বরগুনা পৌর শহরের একাধিক ব্যক্তি নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, পৌর শহরের বিকেবি রোডের শহরের ধানসিঁড়ি এলাকার আবু বক্কর সিদ্দিকির ছেলে নয়ন মাদকাসক্ত। কয়েক বছর আগে মাদক সেবনের টাকা সংগ্রহ করার জন্য সে ছিচকে চুরি আর মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের মাধ্যমে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে সে। এক পর্যায়ে সে শুরু করে ইয়াবার ব্যবসা। নিজ বাসা মাদক সেবনের বড় আখড়ায় পরিনত করে সে। চুরি আর ছিনতাই ছাড়াও চাঁদাবাজীর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বাকীতে সদায় বিক্রি করতে রাজী না হওয়ায় ১ বছর আগে বিকেবি রোডের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নয়া মিয়ার পা ভেঙ্গে দেয় সে। প্রায় একই সময়ে নয়নকে তার বাসা থেকে প্রায় ১৫ লাখ টাকা মূল্যের ইয়াবা এবং দেশীয় ধারালো অস্ত্র সহ গ্রেফতার করে বরগুনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। এই মামলায় কিছুদিন কারান্তরীন থাকার পর জামিনে মুক্তি পেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে নয়ন। কোন রাজনৈতিক পদ-পদবী না থাকলেও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি সাবেক এমপি ও বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেনের ভায়রা ছেলে ছাত্রলীগ নামধারী রিফাত ও রিশানদের সাথে চলাফেরা করায় কাউকেই পরোয়া করছিল না নয়ন। এমনকি দেলোয়ার হোসেনের বাসায় মাঝে মধ্যে কাজকর্ম করে নয়ন নিজেকে আওয়ামী লীগ প্রমানের চেস্টা করে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
তবে বরগুনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মো. দেলোয়ার হোসেন নয়ন কিংবা রিফাত-রিশানদের কোন ধরনের প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, তিনি তার ভায়রা ছেলেদের পরিচয় দেন না। রিফাইত্যা শালায় (গালি) দুনিয়ার খারাপ। ও নেশা করে ছিনতাই করে। ওদের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। তার একটি মাত্র মেয়ে। এর বাইরে তার কোন আত্মীয়-স্বজন নেই। গত বছর ফেসবুক সহ বিভিন্ন মাধ্যমে তিনি এই বার্তা বরগুনায় প্রচার করেছেন। সুতরাং নয়ন, রিফাত, রিশানকে প্রচ্ছয় দেওয়ার প্রশ্নই আসে না বলে দাবী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের।
সারা বরগুনার মানুষ নয়নকে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী আর চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজীতে অভিযুক্ত করেছে। তাহলে পুলিশ এতদিন তার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিয়েছে জানতে চাইলে বরগুনা সদর থানার ওসি আবির মোহাম্মদ হোসেন বলেন, সে যখনই কোন অপরাধ করেছে, পুলিশ তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পর জামিনে বের হয়ে এসে সে ফের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তার বিরুদ্ধে মাদক, চুরি, ছিনতাই সহ বিভিন্ন অপরাধে ১০টির অধিক মামলা রয়েছে বলে দাবী করেছেন বরগুনা সদর থানার ওসি।
গত বুধবার শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার তার বাবা মো. আব্দুল হালিম দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২জনের নামোল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৫/৬জনকে আসামী করে বরগুনা সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। নয়ন, রিফাত, রিশান ছাড়াও এই মামলার এজাহারনামীয় অন্যান্য আসামীরা হলো চন্দন (গ্রেফতারকৃত), মো. মুসা, রাব্বী আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রায়হান, মো. হাসান (গ্রেফতারকৃত), রিফাত, অলি ও টিকটক হৃদয়। এরা সবাই ছাত্রলীগ নামধারী এবং ছাত্রলীগ পরিচয়ে তারা পুরো বরগুনা দাপিয়ে বেড়ায় বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
তবে উল্লেখিতরা ছাত্রলীগের কেউ নয় এবং ছাত্রলীগের কোন পর্যায়ে তাদের নাম নেই বলে দাবী করেছেন বরগুনা জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি রুবায়েত আদনান অনিক।
বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেনের কাছে নয়নের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দিনরাত রিফাত হত্যাকান্ড নিয়ে কাজ করছেন। রিফাত হত্যার ঘটনায় ইতিমধ্যে মামলার এজাহারনামীয় ৪ নম্বর আসামী চন্দন ও ৯ নম্বর আসামী মো. হাসানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যান্য আসামীদের দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেফতারের চেস্টা চলছে বলে জানান বরগুনার পুলিশ সুপার।