3:12 pm , June 27, 2019
খান রুবেল ॥ বরগুনায় নববধূর সামনে প্রকাশ্যে তার স্বামী কলেজ ছাত্র রিফাত শরীফকে (২৫) কুপিয়ে হত্যার ঘটনা দেশ জুড়ে আলোচনার সৃষ্টি করেছে। বুধবার রাত থেকেই বিষয়টি “টক অব দ্যা কান্ট্রিতে” পরিনত হয়। এমনকি গতকাল বৃহস্পতিবার ঘটনার সুষ্ঠু বিচার সহ খুনিদের কোন প্রকার ছাড় না দিতে নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সেতু মন্ত্রী। ফলে নড়েচড়ে বসেছে বরগুনা প্রশাসন। নিহত রিফাত শরীফ বরগুনা সদর উপজেলার ৬ নম্বর বুড়িরচর ইউনিয়নের মাঠাইল লবনগোলা এলাকার দুলাল শরীফের ছেলে। তিনি বরগুনা সরকারি কলেজের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এবং স্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মী। গতকাল বৃহস্পতিবার শেবাচিমের মর্গে তার ময়না তদন্ত শেষে বিকালে বরগুনার নিজ এলাকায় তার দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। এদিকে রিফাত হত্যা কান্ডের ঘটনায় রাতেই তার বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। গতকাল ভোর রাতেই এজাহারভুক্ত চন্দন নামের এক সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এমনকি প্রধান ঘাতক নয়ন বন্ডকে গ্রেফতারে পুরো বরগুনা জেলা জুড়ে চিড়ুনি অভিযানে চালাচ্ছে পুলিশ ও র্যাব। প্রত্যেকটি সড়ক ও নৌ পথে চেক পোষ্ট বসিয়ে তল্লাশী কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বরগুনার পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন। এর আগে গত বুধবার সকালে বরগুনা শহরের
সরকারি কলেজের সামনে একই কলেজের সম্মান দ্বিতিয় বর্ষের ছাত্র রিফাত শরীফকে নির্মামভাবে কুপিয়ে জখম করে নয়ন বন্ড ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী। এমনকি তাকে আহত করে বীরদর্পে অস্ত্র উঁচিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। এই ঘটনার সিসি ক্যামেরা ও মোবাইল ফোনে ধারনকৃত ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে মুহুর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়। ভিটিওতে দেখা যায়, বরগুনা সরকারি কলেজ সংলগ্ন একটি কিন্ডারগার্টেনের সামনে কলেজ ছাত্র রিফাত এর ওপর দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে একের পর এক কুপিয়ে জখম করছে নয়ন বন্ড, তার সহযোগী রিফাত ফরাজী, চন্দন সহ ১০/১২ জন। এসময় তার স্ত্রী বরগুনা সরকারি কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী আয়শা আক্তার মিন্নি তাদের বাধা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। কিন্তু তার বাধা সত্ত্বেও সন্ত্রাসীরা রিফাতের সারা শরীরে এলোপাথারী কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে। তখন হাতে থাকা একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে কোন রকমে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে রিফাত। কিন্তু তা যথেষ্ট ছিলো না। সন্ত্রাসীরা তার বুক, পিঠ, মাথা ও পায়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত করতে থাকে। এসময় মিন্নি একবার সন্ত্রাসী নয়নকে, আরেকবার নয়নের সহযোগী রিফাত ফরাজীকে আটকানোর চেষ্টা করে এবং ‘বাঁচাও’, ‘বাঁচাও’ বলে চিৎকার করে।
এদিকে ঘটনার পর পরই স্থানীয়রা রিফাতকে উদ্ধার করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য বুধবার দুপুর ১টায় তাকে শেবাচিম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকাল সোয়া ৪টায় মৃত্যু হয় রিফাতের। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে শেবাচিমের মর্গে তিন সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল টিম তার ময়না তদন্ত সম্পন্ন করেন।
হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার দুপুরে বরগুনা শহরে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ এবং মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে বরগুনা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা রিফাতের হত্যাকারীদের দৃষ্টন্তমুলক বিচার দাবী করেন। তাছাড়া খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি শফিকুল ইসলাম। তিনি আসামীদের দ্রুত গ্রেফতারের আশ^াস দিয়েছেন।
এদিকে নিহতের স্বজনরা জানিয়েছেন, গত প্রায় দুই মাস পূর্বে বরগুনা পুলিশ লাইন এলাকার মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের মেয়ের আয়শা আক্তার মিন্নিকে বিয়ে করে রিফাত শরীফ। বিয়ের পরেও এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী ও একাধিক মামলার আসামী নয়ন বন্ড মিন্নিকে বিভিন্ন ভাবে উত্যক্ত করে আসছিলো।
রিফাতের বন্ধু সানজিদ অভিযোগ করে বলেন, রিফাতের মৃত্যুর জন্য তার স্ত্রী মিন্নিই দায়ি। কেননা মিন্নি’র সাথে নয়নের দীর্ঘ দিনের প্রেম ছিলো। এমনকি তারা গোপনে বিয়ে করেছে বলেও শোনা যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, নিহত রিফাত ও হত্যাকারী নয়ন দু’জনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো। ২০১১ সালে তারা দু’জন একই সাথে বরগুনা জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে। রিফাতের মিন্নি’র বিয়ের পর থেকেই তাদের মধ্যে শত্রুতার সৃষ্টি হয়।
তার মধ্যে বিয়ের পর মিন্নির সাথে নয়নকে দেখা করতে দিচ্ছিলো না রিফাত। তাই নয়ন মিন্নিকে নিয়ে তোলা বিভিন্ন আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে পোষ্ট করে। এ নিয়ে নয়ন ও রিফাতের মধ্যকার বিরোধ আরো তুঙ্গে ওঠে। ঘটনার দিন অর্থাৎ বুধবার সকালে রিফাত তার স্ত্রী মিন্নিকে কলেজে দিয়ে পার্শ্ববর্তী বাজারে যায়। সেখান থেকে পুনরায় স্ত্রীকে নিয়ে যেতে কলেজে আসে রিফাত।
একই সময় নয়ন মিন্নিকে তার সাথে যাওয়ার জন্য বলে। কিন্তু তাতে বাধা হয়ে দাড়ায় রিফাত। এ কারনেই নয়ন তার সহযোগী রিফাত ফরাজী, চন্দন, সহ ১০/১২ জন মিলে মিন্নির স্বামী রিফাতের ওপর হামলা করে। তার মধ্যেই নয়ন বরগুনা সরকারি কলেজ সংলগ্ন বাসা থেকে ধারালো অস্ত্র এনে রিফাতের ওপর হামলা করে। তাকে এলোপাথারী কুপিয়ে জখম করে।
রিফাতের অপর বন্ধু ও বরগুনা পৌরসভার প্যানেল মেয়রের ছেলে জন বলেন, নয়ন এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। ২০১২ সালে ১২ লক্ষাধিক টাকার মাদকের চালান নিয়ে আটক হয়েছিলো। রিফাত ইতিপূর্বে ছাত্রলীগের কর্মী ছিলো। কিন্তু বিয়ের পরে সে যুবলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়। সে এলাকার ভদ্র ছেলে ছিলো। মিন্নিকে বিয়ে করার কারনেই নয়নের সাথে তার শত্রুতার সৃষ্টি হয়। রিফাতকে সরিয়ে দিয়ে মিন্নিকে পাওয়ার জন্যই নয়ন তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে এই হামলার ঘটনা ঘটায় বলে অভিযোগ জনের।
অপরদিকে অভিযুক্ত নয়ন বন্ডের মা সাহেদা বেগম সাংবাদিকদের জানান, সাত মাস পূর্বে কাজী অফিসে ৫ লাখ টাকা দেনমোহরে নয়নের সাথে মিন্নি’র বিয়ে হয়। পরে মিন্নি’র সাথে রিফাতের প্রেমের সম্পর্ক হয়। যা জানতে পেরে যায় নয়ন। এ নিয়ে তাদের দাম্পত্য জীবনে কলহের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায় তা বিবাহ বিচ্ছেদে রূপ নেয়। প্রায় দু’মাস পূর্বে মিন্নি নয়নকে তালাক দেয় এবং কিছুদিন পর রিফাতকে বিয়ে করে।
তবে নিহত রিফাতের শ্বশুর ও মিন্নি’র বাবা মোজ্জামেল হোসেন কিশোর মেয়ের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার মেয়ে কখনই মাদকের সংস্পর্শে যায়নি। এমনকি নয়নের সাথেও তার কোন সম্পর্ক ছিলো না। বিয়ের পর থেকেই নয়ন, মিন্নিকে নিজের স্ত্রী দাবী করে উত্যক্ত করে আসছিলো। যা রিফাত ও তার শ্বশুর বাড়ির লোকেরাও জানে। এতে বাধা দেয়ার কারনেই রিফাতের ওপর হামলা হয় বলে দাবী তার।
এদিকে মেয়েকে বাচিয়ে সাংবাদিকদের এমন বক্তব্য দিতে গিয়ে বরিশাল শেবাচিমের মর্গ এলাকায় রিফাতের বন্ধুদের তোপের মুখে পড়েন মিন্নি’র বাবা মোজ্জামেল হোসেন কিশোর। এসময় রিফাতের বন্ধুরা তার ওপর হামলার চেষ্টাও করে। কিন্তু উপস্থিত লোকেদের হস্তক্ষেপে রক্ষা পান তিনি।
বরগুনার পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন বলেন, হত্যাকান্ডের ঘটনায় বুধবার রাতেই ১২ জনকে আসামী করে নিহতের বাবা একটি মামলা দায়ের করেছেন। বৃহস্পতিবার ভোর রাতে চন্দন নামের এক আসামীকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। বাকি আসামীদের গ্রেফতার করতে বরগুনার প্রতিটি উপজেলার সড়ক ও নৌ পথে চেকপোষ্ট বসানো হয়েছে। পাশাপাশি বিশ্বস্থ সোর্স নিয়োগ ও পুলিশের তল্লাশী কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এসপি বলেন, ঘটনার মুল হোতা নয়ন বন্ড অনেক আগে থেকেই আলোচিত। ইতিপূর্বে সে বেশ কয়েকবার মাদক সহ আটক হয়। তার বিরুদ্ধে ১০/১২টি’র উপরে মামলা রয়েছে। তাকে গ্রেফতারে পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। খুব দ্রুতই তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে জানিয়ে এসপি বলেন, হত্যার রহস্য পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মুল হোতা নয়নকে গ্রেফতার করা গেলে এ রহস্য উন্মোচন হবে।