দেড় বছরে আলোর পথে ফিরেছে ১১৫৫ মাদকসেবী ও বিক্রেতা দেড় বছরে আলোর পথে ফিরেছে ১১৫৫ মাদকসেবী ও বিক্রেতা - ajkerparibartan.com
দেড় বছরে আলোর পথে ফিরেছে ১১৫৫ মাদকসেবী ও বিক্রেতা

3:21 pm , June 26, 2019

সাঈদ পান্থ ॥ হাকিম হাওলাদার। বাড়ি পিরোজপুর জেলার নাজিরপুরের উত্তর লেবুজিলবুনিয়া গ্রামে। এক বছর আগেও তার স্বজনদের জন্য তিনি ছিল দুর্ভাবনা আর হতাশার কারণ। পরিবারের বোঝা আর সমাজের জন্য ছিল পুরোদস্তুর আতঙ্ক। হেরোইন, গাঁজা, ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদকে আসক্ত হয়ে চুরি, ছিনতাইসহ এমন কোনো খারাপ কাজ নেই, যা সে করত না। কখনও সে ভাবেনি সেই অন্ধকার পথ থেকে ফিরে এসে নতুন করে পরিবারের হাল ধরতে পারবে। এই সমাজে বাঁচবে নিজের মর্যাদা নিয়ে। কিন্তু সেই অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েই আজ হাকিম হাওলাদারসহ বিভাগের ১ হাজার ১৫৫ জন মাদক সেবী ও মাদক ব্যবসায়ী নতুন করে নিজেদের প্রমান করেছেন। অনুপ্রেরণা আর বাস্তব সহায়তা পেয়ে বদলে ফেলেছেন নিজেকে। আর এমন একটি বাস্তবমূখি কাজ করেছেন ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বিপিএম, পিপিএম বার।
ডিআইজি কার্যালয়ের তথ্য মতে, গত দেড় বছরে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় ১ হাজার ১৫৫ জন মাদক সেবী ও মাদক ব্যবসায়ী আত্মসমর্পন করেছে। এর মধ্যে ২৮৭ জনকে অন্ধকার পথ থেকে আলো পথে ইতোমধ্যে ফিরে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। পূর্নবাসনের পর্যায়ে রয়েছে ৮৯৫ জন। এর মধ্যে বেশি করেছে বরিশাল জেলায় ১৯০ জন, পটুয়াখালীতে ১৫৭ জন, ভোলা ১৫৫, বরগুনা ১৪৮, ঝালকাঠীতে ১৪১ জন এবং পিরোজপুর জেলায় ১০৪ জন মাদক সেবী ও মাদক ব্যবসায়ী। এছাড়া বরিশালের ৬ জেলায় মদকসেবী নিরাময় কেন্দ্রের ভর্তির হালনাগাদ তথ্য মতে, ৬ জেলায় মোট ২৬০ জন মাদকসেবী নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হয়। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে যায় ২২১ জন। বর্তমানে মাদকসেবী নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন আছে ৩৯ জন। এর মধ্যে বরিশাল জেলায় মদকসেবী নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তির সংখ্যা ৩৭ জন। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে যায় ৩৩ জন। বর্তমানে মাদকসেবী নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন আছে ৪ জন। পটুয়াখালী জেলায় মদকসেবী নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তির সংখ্যা ৪০ জন। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে যায় ২৬ জন। বর্তমানে মাদকসেবী নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন আছে ৪ জন। ভোলা জেলায় মদকসেবী নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তির সংখ্যা ৪৯ জন। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে যায় ৩৮ জন। বর্তমানে মাদকসেবী নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন আছে ১১ জন। বরগুনা জেলায় মদকসেবী নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তির সংখ্যা ৪৩ জন। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে যায় ৩৭ জন। বর্তমানে মাদকসেবী নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন আছে ৬ জন। পিরোজপুর জেলায় মদকসেবী নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তির সংখ্যা ৩৩ জন। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে যায় ২৯ জন। বর্তমানে মাদকসেবী নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন আছে ৪ জন। ঝালকাঠী জেলায় মদকসেবী নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তির সংখ্যা ৫৮ জন। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে যায় ৪৯ জন। বর্তমানে মাদকসেবী নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন আছে ১০ জন।
বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার লিগ্যাল এইডে মামলা পরিচালনার জন্য যে সকল মাদক সেবী ও মাদক ব্যবসায়ী আবেদন পরেছে তার পরিসংখ্যান তথ্য মতে, বরিশাল রেঞ্জাধীন ১৬২ টি মামলা পরিচালনার জন্য আবেদন গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে বেশি আবেদন নেয়া হয়েছে ভোলায় ৫৯টি এবং সব থেকে কম আবেদন হয়েছে বরগুনায় ৭টি। এছাড়া বরিশাল ২৩ টি, পটুয়াখালী ৩৬ টি, পিরোজপুর ১৯ এবং ঝালকাঠিতে ১৮টি মামলা লিগ্যাল এইডে পরিচালনার জন্য দেয়া হয়েছে। ৬ জেলার মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীদের পূনর্বাসন এর পরিসংখ্যান তথ্যমতে, মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীদের মোট ২৮৭ জনকে পূনর্বাসন করা হয়েছে। পিরোজপুর জেলায় সব থেকে বেশি  পূনর্বাসন এর আওতায় আনা হয়েছে ৭২ জন এবং পটুয়াখালী এবং ঝালকাঠীতে ২৫ জনকে পূনর্বাসনের আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়া বরিশালে ৬৮ জন, ভোলায় ৩২ জন, বরগুনায় ৬৫ জনকে পূনর্বাসন এর আওতায় আনা হয়েছে।
বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ দেশে প্রায় ৬৮ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত। এর মধ্যে ৮৪ ভাগ পুরুষ, ১৬ ভাগ নারী। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু-কিশোররাও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া তথ্যানুযায়ী দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭৫ লাখ। আসক্তের শতকরা ৯০ ভাগকে কিশোর-তরুণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তার শতকরা ৪৫ ভাগ বেকার ও ৬৫ ভাগ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট। আর উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা ১৫ শতাংশ। তবে আরও বেশ কয়েকটি সংস্থার তথ্যানুযায়ী অবৈধ মাদকদ্রব্য আমদানির জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটিরও বেশি টাকার মুদ্রা বিদেশে পাচার হচ্ছে। বেসরকারি এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, মাদকসেবীরা গড়ে প্রতিদিন অন্তত ২০ কোটি টাকার মাদক সেবন করে, হিসাব অনুযায়ী মাসে ৬০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে সারা দেশে প্রায় ৩০ লাখ মাদক ব্যবসায়ী প্রতিদিন কমপক্ষে প্রায় ২০০ কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা করে। আরও একটি ভয়ঙ্কর চিত্র হচ্ছে, সারা দেশের ছড়িয়ে পড়া ইয়াবার শতকরা ৮৫ ভাগই ভেজাল। যার ফলে এসব ইয়াবা গ্রহণকারী মাদকাসক্ত নানান ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তার মধ্যে কিডনি, লিভার ছাড়াও মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী শতকরা ৮০ ভাগ খুনের সঙ্গে মাদকাসক্তরা জড়িত।
আলোর পথে ফেরা মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীরা বলেন, তারা কেউ বন্ধুদের কবলে পড়ে বা হতাশা থেকে মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন। এতে করে তাদের পরিবারের সাথে বিরোধ ও সমাজের মানুষ ঘৃণার চোখে দেখেন। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে থানা পুলিশের সহায়তা করার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা আত্মসমর্পণ করেছেন। এখন থেকে তারা অন্যকেও মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করবেন। বরিশালে আত্মসমর্পণকারী জুয়েল খান বলেন, ‘আমি মাদক বিক্রি এবং সেবন করতাম। মাদকের কারণে সমাজ আমাকে বাঁকা চোখে দেখতো। এ কারণে পুলিশের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমি আলোর পথে ফিরে এসেছেন। মেহেন্দিগঞ্জের মোঃ হাসান বলেন, তিনি নিজের উপলব্ধি থেকে মাদক ছেড়ে দিয়েছেন। এখন থেকে তিনি নিজেতো মাদক গ্রহণ করবেনই না; বরং যে মাদক সেবন করবে তাদেরকেও পুলিশে ধরিয়ে দেবেন। রিক্সাচালক মজিবর মুন্সি বলেন, মাদক সেবন কিংবা বিক্রি করলে মানুষ খারাপ বলে। তাই তিনি ভাল হতে চান। এ কারণেই পুলিশের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। এখন বাকি জীবন আর অন্ধকার পথে হাঁটবেন না। বরিশালের পুলিশ সুপার মো: সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কমিউনিটিং পুলিশিং বা অন্যকোনো সভায় প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে মাদক। তাই সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। বাকি যারা রয়েছে তাদেরকেও আত্মসমর্পণ করার আহ্বান করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে বরিশাল রেঞ্জ পুলিশের চৌকস উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো: শফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘মাদকসেবী বা ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনে সরকারি কোনো বরাদ্দ নেই। সংশ্নিষ্ট এলাকার প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের উৎসাহিত করে তাদের সহায়তা নিয়ে মাদকসেবী বা ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যেসব মাদকসেবী ও ব্যবসায়ী ইতিমধ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে, তাদেরকে একত্রিত করে অঞ্চলভিত্তিক সমবায় সমিতি গঠনের পরিকল্পনাও রয়েছে তার। যা নিঃসন্দেহে মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করবে।’ তিনি বলেন, ‘মাদক সেবী ও মাদক ব্যবসায়ীদের পূনর্বাসন করতে তাদের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে সেলাইমেশিন প্রশিক্ষণ ও তাদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। দেয়া হয়েছে রিক্সা, ভ্যান গাড়ী, চা বিক্রির সরঞ্জামাদী, মাছ শিকারের জাল ও নগদ অর্থ।’

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT