দক্ষিণাঞ্চলের বাঁধ ও পানি নিয়ন্ত্রন অবকাঠামো পূণর্বাসন জরুরী দক্ষিণাঞ্চলের বাঁধ ও পানি নিয়ন্ত্রন অবকাঠামো পূণর্বাসন জরুরী - ajkerparibartan.com
দক্ষিণাঞ্চলের বাঁধ ও পানি নিয়ন্ত্রন অবকাঠামো পূণর্বাসন জরুরী

3:02 pm , June 15, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ দক্ষিন উপকুল যুড়ে প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার ‘উপকুলীয় বণ্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ’এর বেশীরভাগই ঝুকিপূর্ণ। সাগরের লবনাক্ততা থেকে ফসলী জমি রক্ষা সহ উপকুলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়ন এবং জীব বৈচিত্র রক্ষায় ‘মার্কিন সাহায্য সংস্থাÑ ইউএসএইড’ এর সহায়তায় ১৯৬০ সাল থেকে ’৮০ সালের মধ্যে মাত্র ৩৮ কোটি ৬০লাখ টাকা ব্যয়ে দক্ষিণের বিশাল উপকুলীয় এলাকায় বণ্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ সহ বিভিন্ন ধরনের পানি অবকাঠামো নির্মান করা হয়। এরফলে বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলার প্রায় ৬ লাখ একর জমি লবনাক্ততা থেকে রক্ষার পাশাপাশি ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। প্রকল্প এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ড খালাসী সেড, বাস ভবন, গুদামসহ ১৮৮টি বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো ছাড়াও প্রায় ৩শ ড্রেনেজ স্লুইস ও ফ্লাশিং স্লুইস সহ ২৭২টি রিভার ক্লোজার নির্মান করে। এরফলে দক্ষিনাঞ্চলের কৃষি, বণ্যা নিয়ন্ত্রন ও আর্থ-সামাজিক ব্যাবস্থা সহ জীব বৈচিত্র রক্ষায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। কিন্তু প্রকল্পটির শুরু থেকে শেষ করতে সময় লেগেছে প্রায় ২০ বছর। এসময়কালের মধ্যেই অনেক বণ্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ সহ পানি অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্থ হবার পাশাপাশি সাগরের ঢেউ ছাড়াও একাধীক ঝড়Ñজলোচ্ছাসে উপকুলীয় বাঁধ এবং বিভিন্ন অবকাঠামো একাধিকবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কিন্তু মেরামত সহ পরিপূর্ণ পূর্ণবাসনে তহবিল সংকট ছিল সব সময়ই। এমনকি স্বাভাবিক অবস্থাতেই বছরে যেখানে রক্ষনাবেক্ষন ব্যয় ২৫ কোটি টাকা, সেখানে এর এক তৃতীয়াংশ অর্থও কখনো পাওয়া যায়নি। এমনকি ইতোপূর্বে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমেই ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী’র আওতায় উপকুলীয় বণ্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ সহ বিভিন্ন অবকাঠামো মেরামত ও পূণর্বাসন হলেও গত এক দশকেরও বেশী সময় ধরে তা বন্ধ। এক হিসেবে দেখা গেছে ১৯৮১-৮২ সালে উপকুলীয় বণ্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ সহ অবকাঠামো সমুহ রক্ষনাবেক্ষনে বরাদ্ধ ছিল মাত্র ৮০ লাখ টাকা। এর পরের বছর ওই বরাদ্ধ মাত্র ৬২ লাখ টাকায় হ্রাস করা হয়। সেসময়ই বছরে মেরামত ও রক্ষনাবেক্ষন চাহিদা ছিল প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা।
১৯৮০ সালে ইউএসএইড ভূক্ত প্রকল্পটির কাজ শেষ হবার পরে আরো বিভিন্ন দাতা সংস্থার অর্থায়নে উপকুলীয় এলাকায় বেশ কিছু বাঁধ ও পানি অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চলের জেলা সমুহে ৮৭টি পোল্ডারে ৩ হাজার ৭৪৩ কিলোমিটার উপকুলীয় বণ্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ ছাড়াও ১ হাজার ৯৯টি রিভার ক্লোজার এবং প্রায় ১ হাজারটি ইনলেট স্ট্রাকচার, সোয়া ২শ ব্রীজ ও কালভার্ট ছাড়াও পৌনে ৩শ ক্রসড্যাম রয়েছে।
কিন্তু একাধিক প্রাকৃতিক দূর্যোগে এসব উপকুলীয় বাঁধ সহ পানি অবকাঠামোর একটি বড় অংশই ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। উপরন্তু ১৯৬০ সালে যে উচ্চতায় এসব বাঁধ নির্মানের নকশা প্রনয়ন করা হয়, সময়ের বিবর্তনে তার পরিবর্তনও জরুরী বলে মনে করছেন পানি বিশেষজ্ঞ মহল। পাশাপাশি ক্রমাগত সাগর ও নদ-নদীর শ্রোত এবং ঢেউ আছড়ে পড়ায় এসব বাঁধের বেশীর ভাগই ক্ষয়িষ্ঞুপ্রায়। বরগুনার রংগাবালী ও ভোলার কয়কটি এলাকায় প্রায় ২০ কিলোমিটার উপকুলীয় বাঁধ বিলীন হয়ে বর্তমানে উন্মুক্ত অবস্থায় রয়েছে। এসব বাঁধ পূণর্বাশন অত্যন্ত জরুরী। অবিলম্বে উপকুলীয় এসব বাঁধ সহ পানি অবকাঠামো সমুহ মেরামত ও পূণর্বাশন না করলে দেশের উপকুলীয় এলাকার কৃষি ও স্বাস্থ্য সহ আর্থ-সামাজিক ব্যাবস্থার পাশাপাশি জীববৈচিত্র চরম হুমকির মুখে পড়তে পরে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল।
সিডর, আইলা ও মহাশেন-এর একের পর এক তান্ডবে বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠী, বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলা সমুহে প্রায় ৩শ কিলোমিটার উপকুলীয় বাঁধ সম্পূর্ণ ও দেড় হাজার কিলোমিটার আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়াও এসব উপকুলীয় জেলা সমুহের বাঁধের বিভিন্ন পানি নিয়ন্ত্রন অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতিও ছিল ব্যাপক। উল্লেখিত জেলাসমুহে প্রায় ৩শটি পানি নিয়ন্ত্রন অবকাঠামো সম্পূর্ণ ও আরো ৫শতাধীক আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ্য হয়। উপকূলীয় বণ্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ, নদী তীর সংরক্ষন বাঁধ, রেগুলেটর, ফ্লাশিং স্লুইস গেট সহ বিভিন্ন পানি নিয়ন্ত্রন অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি মেরামত ও পূণর্বাসণে কয়েক হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হলেও সময়মত তহবিলের সংস্থান না হওয়ায় সিডর-এর প্রায় এক যুগ পরেও এখনো ক্ষয় ক্ষতির পূণর্বাসন চলছে।
তবে পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, ঝড় জলোচ্ছাসে ক্ষয়ক্ষতির পূণর্বাসণ ছাড়াও গোটা উপকুলীয় এলাকার বাঁধসমুহের উচ্চতা ও প্রশস্ততা বৃদ্ধি সহ নতুন নকশায় ঢাল তৈরী করে সাগরের জলোচ্ছাসকে প্রতিহত করার উদ্যোগ জরুরী। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক-এর ইসিআরপি প্রকল্প, ডাচ সরকারের ‘ব্লু-গোল্ড প্রগ্রাম’ ও ‘সিআইপি-১’ এর আওতায় প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা টাকা ব্যয়ে সিডর, আইলা ও মহাশেন-এর ক্ষতি পূণর্বাসন সহ ক্ষতিগ্রস্থ উপকূলীয় বাঁধ সহ পানি নিয়ন্ত্রন অবকাঠামো সমুহের মেরামত শুরু হয়েছে। তবে তা দক্ষিণাঞ্চলের উপকুলের ৮৭টি পোল্ডারের মধ্যে মাত্র ২৭টিতে সীমাবদ্ধ রয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে বিশ্ব ব্যাংকের সাহায্যপুষ্ট প্রায় সাড়ে ৭শ কোটি টাকা ব্যয়ে পটুয়াখালী, বরগুনা ও পিরোজপুরের ১২টি পোল্ডারে ইসিআরপি প্রকল্পের আওতায় ১৯.৭৬ কিলোমিটার স্থায়ী নদী তীর সংরক্ষন, ৩৫.৪৩ কিলোমিটার বাঁধ নির্মান, ৪৮০ কিলোমিটার বাঁধ মেরামত, ১৭৪টি পানি অবকাঠামো নির্মান ছাড়াও ১৯১টির মেরামত প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
এছাড়া ডাচ সরকারের ‘ব্লু-গোল্ড’ প্রেগামের আওতায় প্রায় ৫৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার ৯টি পোল্ডারে ৫৮৯ কিলোমিটার উপকুলীয় বাঁধ মেরামত, ৮৫৪ কিলোমিটার নিস্কাশন খাল খনন ও ৯০টি পানি অবকাঠামোর মেরামত চলছে।
জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় গৃহীত ‘সিইআইপ-১’ প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালী, বরগুনা ও পিরোজপুরের ৬টি পোল্ডারে ২০৯ কিলোমিটার বাঁধ নির্মান ও পুনঃ নির্মান করা হচ্ছে। এছাড়াও প্রায় ২শ কিলোমিটার নদী ও খাল খনন সহ পুনঃ খনন, ১২৩টি পানি অবকাঠামো নির্মান এবং প্রায় সাড়ে ৫ কিলোমিটার নদী তীর সংরক্ষন সহ ৮টি ক্লোজার ছাড়াও আনুষাঙ্গিক অন্যান কাজ করা হচ্ছে। তবে নিরাপদ উপকুলের জন্য দক্ষিনাঞ্চলের ৮৭টি পোল্ডারের প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার উপকুলীয় বণ্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ সহ পানি অবকাঠামো সমুহের পূর্ণবাসনের কোন বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল।
এসব ব্যাপারে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল (অবঃ) জাহিদ ফারুক শামিম-এর সাথে আলাপ করা হলে তিনি জানান, ‘এ বিষয়টি পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় সম্পূর্ণ সচেতন রয়েছে। কিভাবে এসব বাঁধ মেরামত ও পূণর্বাসন করা যায়, সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যে আমরা বরিশাল ও ঢাকায় একাধিক সেমিনার সহ মত বিনিময় সভা করেছি। সেখান থেকে অনেক তথ্য-উপাত্ত সহ বাস্তব কিছু মতামত পাওয়া গেছে। পুরো বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে’ বলেও জানান পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT