বাংলাদেশ ব্যাংকে নতুন নোটের রমরমা বানিজ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে নতুন নোটের রমরমা বানিজ্য - ajkerparibartan.com
বাংলাদেশ ব্যাংকে নতুন নোটের রমরমা বানিজ্য

3:15 pm , May 30, 2019

খান রুবেল ॥ ঈদ সালামিতে নতুন টাকার নোট দেয়ার রীতি-নীতি পুরানো দিনের। তাই ঈদ এলে বেড়ে যায় নতুন নোটের চাহিদাও। এজন্য ছেড়া- ক্ষতিগ্রস্থ নোটের পরিবর্তে নতুন নোটের ব্যবস্থা করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এ টাকা সঠিকভাবে পৌছায় না সাধারণ মানুষের হাতে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সিংহভাগ নোট চলে যায় ‘নতুন টাকা’ ব্যবসায়ীদের হাতে। এমনই এক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক বরিশাল শাখা থেকে নতুন টাকার নোট বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। প্রতি বাক্স নতুন নোট বিক্রি করে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেটটি। আর এই অভিযোগ খোদ ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ব্যাংকিং) মো. মাহবুবর রহমানের বিরুদ্ধে। যিনি ব্যাংকের কতিপয় কর্মচারী এবং বহিরাগত দালালদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘নতুন নোট বিক্রি’র সিন্ডিকেট। সরেজমিনে এমন অভিযোগের প্রমানও মিলেছে। এর পরেও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন উপ-মহা ব্যবস্থাপক (ব্যাংকিং) মাহবুবর রহমান। তবে অভিযোগ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহনের কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংক বরিশাল শাখার নির্বাহী পরিচালক (ই.ডি) মনোজ কুমার বৈরাগী। বাংলাদেশ ব্যাংক বরিশাল শাখার কয়েকটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ঈদ-উল-ফিতরে নতুন নোটের চাহিদা বেশি থাকে। সে জন্য কেন্দ্র থেকে বরিশাল শাখায় পর্যাপ্ত রেমিটেন্সও আসে। এ থেকেই সাধারণ মানুষের চাহিদার পরিমান অর্থ বুঝিয়ে দিবে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু বাস্তবিকভাবে অর্থে বাংলাদেশ ব্যাংক বরিশাল শাখায় তেমনটি ঘটেনি। সাধারণ মানুষকে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাড় করিয়ে রেখে নামে মাত্র নতুন নোট দিলেও সিংহভাগ টাকা বিক্রি করে দেয়া হয়েছে অবৈধ টাকা ব্যবসায়ীদের কাছে।
সূত্রগুলো জানায়, ঢাকা থেকে বাক্স ভর্তি টাকা আসে বরিশাল শাখায়। যার একটি বাক্সে ৫০ হাজার পিস নোট থাকে। সে অনুযায়ী ৫ টাকার বাক্সে আড়াই লাখ, ১০ টাকার বাক্সে ৫ লাখ এবং ২০ টাকার বাক্সে থাকে ১০ লাখ টাকার নতুন নোট। বাক্সগুলো খুলে প্রতিদিন সর্বোচ্চ হলে একটি বাক্সের টাকা সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়।
বাকি বাক্সগুলো সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাইরে নতুন ও ছোড়া-ফাঁটা নোট ব্যবসায়ীদের কাছে পৌছে যায়। যার বিনিময়ে ৫০ হাজার পিস পরিমান ৫ টাকার নোটের জন্য ১০/১৫ হাজার, ১০ টাকার নোটের জন্য ২০ থেকে ২৫ হাজার ও ২০ টাকার নোটের জন্য ৩০ হাজার টাকা লাভ হচ্ছে সিন্ডিকেটের। তবে প্রথম দিক থেকে নোটের পরিমান কম থাকায় যে কোন নোট বাক্স প্রতি ৩০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি বিশ^স্থ সূত্র জানিয়েছে, বাংকের উপ-মহা ব্যবস্থাপক (ব্যাংকিং) মো. মাহাবুবর রহমান নতুন টাকা বেচা-বিক্রির সিন্ডিকেট পরিচালনা করছেন। আর এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংক বরিশাল শাখার কেয়ারটেকার শেখ জাহাঙ্গীর।
এছাড়া সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে রয়েছে নতুন ও ছেড়া-ফাঁটা টাকা ব্যবসায়ী নগরীর পলাশপুর এলাকার বাসিন্দা জলিল মোল্লা, বরাত, নুরুল ইসলাম ও শুক্কুর সরদার সহ কয়েকজন। এদের মধ্যে প্রধান বরাত ও নুরুল ইসলাম। এরা সবাই নগরীর কালেক্টরেট পুকুর সংলগ্ন নগর ভবনের পেছনে ও চক বাজার এলাকায় রাস্তার পাশে বসে ছেড়া-ফাটা ও নতুন নোটের ব্যবসা করে থাকেন।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত এক একজন কর্মচারী সর্বোচ্চ ৮শ নোট ও শাখার সর্বোচ্চ কর্মকর্তা নির্বাহী পরিচালক ৩৮শ নতুন নোট পাবেন। এছাড়া প্রতিজন সাধারণ মানুষ পাবে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা। সেখানে ব্যাংকিং শাখার ডিজিএম মাহবুবর রহমান বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে প্রতিদিন হাজার হাজার পিস নতুন নোট যাচ্ছে। তিনি স্লিপের মাধ্যমে ওই টাকাগুলো বিভিন্ন লোকের নামে ছাড় করে থাকেন। এভাবেই গত ২৮ মে ১০ টাকা ২০ টাকা নোটের ৫ বাক্স ও ২৯ মে ৩ বাক্স নতুন টাকা ব্যাগ ভরে বাইরে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে।
সরেজমিনে এমনই একটি প্রমান খুঁজে পাওয়া গেছে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে টাকা কেনা-বেচা সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য জলিল মোল্লা একটি কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশ করেন। ক্যাশ বিভাগে ব্যাগটি রেখে ১০ মিনিটের মাথায় বেরিয়ে আসেন তিনি।
এর পর দুপুর সোয়া ২টায় জলিল মোল্লার সাথে দেখা হয় নগর ভবনের পেছনে তার টাকা ব্যবসার প্রতিষ্ঠানে। ঠিক সেই মুহুর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকে রেখে আসা ওই ব্যাগটি নিয়ে ওই স্থানে হাজির হয় অপর একটি যুবক। যার মধ্যে টাকা ভর্তি ছিলো। ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করতেই জলিলের ইশারায় ব্যাগটি গুটিয়ে রিক্সায় করে দ্রুত চলে যায় ওই যুবক।
টাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে জলিল সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে বলেন, বৃহস্পতিবারের পর থেকে আর নতুন নোট পাওয়া যাবে না। তাই বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ওই নতুন টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে অনেক সময় দাড়িয়ে থাকতে হয় বিধায় আমরা সেখান থেকে টাকা আনি না। এমনকি ব্যাগ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশের কথাও অস্বীকার করেন তিনি।
এদিকে একই স্থানে টাকার ব্যবসা করা পলাশপুরের বাসিন্দা মো. নাসির বলেন, এটি তাদের বাবা ও দাদার পেশা ছিলো। এখন তিনিও একই পেশার সাথে যুক্ত হয়েছেন। এটা দিয়েই তার সংসার চলছে এবং তা খুব ভালো ভাবেই।
নাসির বলেন, প্রতি এক হাজার নতুন নোটে ৩০ টাকা লাভ হয়। এখন ঈদ মৌসুম তাই গত কয়েক দিন ধরে এক একজন ব্যবসায়ী প্রতিদিন ২০ থেকে ২৩ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে। ২৫ রোজার পরে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত প্রতিদিন কম করে হলেও ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা বিক্রি হবে বলে ধারনা তার।
প্রতিদিন এতো পরিমান নতুন নোটের উৎস কোথা থেকে আসে এমন প্রশ্নের উত্তরে নাসির বলেন, এখন সব ব্যাংকেই নতুন নোট দিয়ে থাকে। তাই আমরা কয়েকজন লাইনে দাড়িয়ে নতুন নোট সংগ্রহ করে থাকি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কারোর সাথে তাদের লেনদেন নেই বলে দাবী নাসিরের।
এদিকে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে নগরীর বগুরা রোডে বাংলাদেশ ব্যাংক বরিশাল শাখার উপ-মহা ব্যবস্থাপক (ব্যাংকিং) মো. মাহবুবর রহমান এর অফিস কক্ষে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। দুপুর ২টা পর্যন্ত তার কক্ষে অবস্থান করলেও তিনি কক্ষে আসেননি। বরং সাংবাদিকদের আসার কথা শুনে তিনি ব্যস্ততার কথা বলে এড়িয়ে যান।
পরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি ব্যস্ত তাই দেখা করতে পারিনি। তাছাড়া আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ সেঠাও সঠিক নয়। আমি কোন স্লিপ দেই না। তাই এই বিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না। এই বলে ব্যস্ততা দেখিয়ে মোবাইলের সংযোগ কেটে দেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক বরিশাল শাখার অফিস প্রধান নির্বাহী পরিচালক (ই.ডি) মনোজ কুমার বৈরাগী বলেন, আমি এই শাখায় স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছি। এরই মধ্যে অনেক পরিবর্তনও এসেছে এখানে। পূর্বের অনেক নিয়মই এখন আর নেই।
তিনি বলেন, নতুন নোট দেয়ার জন্য নিয়ম করে দিয়েছে। যিনি টাকা নিবেন তাকে অবশ্যই লাইনে দাড়িয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দিতে হবে। এতে করে এক ব্যক্তি অনেক পরিমান টাকা নিতে পারবে না। সাধারণ মানুষ যাতে সহজে টাকা পেতে পারে সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বাইরে আরো তিনটি ব্যাংকের মাধ্যমে নতুন নোট দিয়েছি। তবে কেউ চাইলেই নির্ধারিত পরিমানের উপরে টাকা নিতে পারবে না। ই.ডি বলেন, আমি ব্যাংকের প্রধান। তাই সকল বিষয়ে আমাকেই খোঁজ খবর রাখতে হয়। কোন বিষয়কে আলাদা ভাবে দেখার সুযোগ থাকে না। তবে নতুন নোট নিয়ে বানিজ্যের যে অভিযোগ উঠেছে সেটা গুরুতর। তাই এ বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT