3:38 pm , May 24, 2019
সাঈদ পান্থ ॥ পূর্নবাসনের কোন ব্যবস্থা না রেখেই টানা প্রায় আড়াই মাসের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে সব ধরনের মাছ শিকার। প্রজনন মৌসুমে ছোট ছোট মাছের রেনু পোনা রক্ষায় এই নির্দেশনা জারী করেছে সরকার। বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে উপকূলীয় এলাকায় জেলেদের আন্দোলন চললেও নিষেধাজ্ঞা প্রশ্নে অনঢ় অবস্থানে থাকার ইঙ্গিত দিয়েছে সরকার। গত ২০ মে থেকে উপকূলীয় এলাকায় ৬৫ দিনের জন্যে মাছ ধরা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যদিও এরই মধ্যে নিষেধাজ্ঞার আগে থেকে নিষেধাজ্ঞা অমান্যের ঘোষণা দিয়েছিল ইলিশ জেলেরা। সাগরে ইলিশ শিকারে যাবে বলে জানিয়েছিল তারা। কিন্তু নিষেধাজ্ঞাকালে তারা অনেকে পালিয়ে পালিয়ে মৎস্য আহরন করছেন। সাগরের ট্যাংরা, পোমা, ফাইলসা, তাপসিসহ বিভিন্ন ছোট ছোট মাছের প্রজননকাল হিসেবে ২০ মে থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত সময়কাল নির্ধারন করেছে দেশের মৎস্য বিভাগ। বাংলা মাসের হিসেবে এটা আষাঢ় এবং শ্রাবন। যদিও একই সমুদ্রে মাছ ধরা ভারতীয় জেলে তথা ভারত সরকারের হিসেবে এই মৌসুম হচ্ছে বৈশাখ ও জৈষ্ঠ। এই নিয়ে জেলেদের মধ্যে ক্ষোভও রয়েছে। তবে এসবকিছু এড়িয়ে আষাঢ়-শ্রাবনকেই ছোট মাছের প্রজনন মৌসুম ধরে ২০ মে থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে সবধরনের মাছ শিকার বন্ধ রাখার ঘোষনা দিয়েছে সরকার।
জানা গেছে, ১৯৮৩ সালে যখন এই আইনটি পাস করা হয় তখন অবশ্য এটি নিয়ে খুব একটা বাদ-প্রতিবাদ ছিলনা। কেননা ৮৩’ সালের ওই আইনে কেবলমাত্র ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ফিশিং’র ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল এটি। কারন ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ফিশিং-এ নিয়োজিত মাছ ধরার আধুনিক ফিশিং বোটগুলোর ব্যবহার করা জালের ফাঁস খুবই সুক্ষ। সেসব জালে কেবল বড় মাছই নয়, রেনু পোনা পর্যন্ত গলবার সুযোগ নেই। ফলে ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ফিশিং বাধাগ্রস্থ হলেও সাগরে মাছ ধরতে পারতো ইলিশ জেলেরা। কারন ইলিশ জেলেদের জালের ফাঁস কমপক্ষে ৪ বর্গ ইঞ্চি। এই ফাঁসে রেনু পোনা আটকানোর সুযোগ নেই। বহাল থাকা ওই আইনের ক্ষেত্রে জটিলতার শুরু ২০১৫ সালে। সে বছর ৮৩’র আইন সংশোধন করে কেবল ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ফিশিং নয়, টানা ৬৫ দিন সমুদ্রে সবধরনের মাছ শিকার বন্ধের আইন করে সরকার। যদিও ওই বছর কিংবা এর পরবর্তি আরো ৩ বছর এই আইনের প্রয়োগ না হওয়ায় জটিলতা বাঁধেনি। চলতি বছর সরকার কঠিনভাবে এই আইন প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিলে দেখা দেয় অস্থিরতা। সরকারী এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে জেলেরা। উপকূলীয় প্রায় সকল জেলা উপজেলায় বিক্ষোভ মানব বন্ধনসহ নানা কর্মসূচী পালনের পাশাপাশি সরকারের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে দেয়া হয় স্মারকলিপি। গত ১৬ মে চট্টগ্রামে এক সভায় যোগ দিতে গিয়ে একই দাবীতে জেলেদের উত্তাল বিক্ষোভের মুখে পড়েন মৎস্য ও প্রানী সম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু।
ওই সভায় উপস্থিত থাকা উত্তর চট্টলা মৎস্যজীবি জলদাস সমবায় কল্যান ফেডারেশন’র সভাপতি লিটন দাস বলেন, ‘অভ্যন্তরভাগের জলসীমায় মাছ ধরা বন্ধের সময়কালে জেলেদেরকে চাল এবং নগদ অর্থ সহায়তা দেয়া হয়। কিন্তু কোনরকম বিকল্প ব্যবস্থা না রেখেই টানা ৬৫ দিনের জন্যে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে গেলে বেকার হয়ে পড়বে ৫০ হাজার জেলে।’ প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ওই সভায় জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে আইনের কার্যকরিতা স্থগিত রাখার অনুরোধ জানান লিটনসহ অন্যান্য জেলে সংগঠনের নেতারা। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে এই সভা চলাকালে একই দাবীতে বাইরে বিক্ষোভ করেন কয়েক হাজার জেলে। যদিও এসব দাবী কিংবা বিক্ষোভে কোন ফল হয়নি। সভায় দেয়া বক্তব্যে মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষে ৬৫ দিনের জন্যে মাছ ধরা বন্ধ রাখার পক্ষেই রায় দেন মৎস্য প্রতিমন্ত্রী। একই সঙ্গে আগামী বছর থেকে এই ৬৫ দিনের কারনে যারা ক্ষতিগ্রস্থ হবেন তাদের জন্যে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহনের ঘোষনা দেন তিনি। মৎস্য প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্য আর ঘোষনা অনুযায়ী ৬৫ দিনের জন্যে সবধরনের মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা জানান। তবে জটিলতা বেঁধেছে ইলিশ জেলেদের দেয়া একটি পাল্টা ঘোষণায়। সরকার নিষেধাজ্ঞা দিলেও ইলিশ জেলেরা সাগরে মাছ ধরা বন্ধ করবেনা বলে জানিয়ে দিয়েছে। এর পর থেকে তারা পালিয়ে পালিয়ে বঙ্গপোসাগরে জাল ফেলছে।
বাংলাদেশ ফিশিং বোট মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘মৎস্য সচিবসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে যতবার এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের বৈঠক হয়েছে ঠিক ততোবারই আমরা বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে ইলিশের জালের ফাঁস ৪ বর্গ ইঞ্চি চওড়া। এই ফাঁসে কোন রেনু পোনা আটকানোর সুযোগ নেই। যেহেতু দোহাই দেয়া হচ্ছে প্রজনন মৌসুমের এবং রক্ষা করার চেষ্টা চলছে ছোট ছোট মাছের রেনু পোনা তাই ইলিশ জালে কোনরকম ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। অতএব সাগরে মাছ ধরবো আমরা।’ তবে প্রকাশ্যে মাছ শিকার করতে না পারলেও পালিয়ে পালিয়ে জেলেরা মাঝ ধরছে বলে জানিয়েছেন অন্য এক বোট মালিক।
বরগুনা ট্রলার মালিক এ্যাসোসিয়েশনের সাধারন সম্পাদক মাসুম আকন বলেন, ‘আমাদের দেশে ইলিশের সবচেয়ে বড় মৌসুম হচ্ছে ১৫ মে থেকে ১৫ অক্টোবর। দেশে উৎপাদিত মোট ইলিশের শতকরা ৮১ ভাগ ধরা পড়ে এই সময়ে। আর এই সময়ে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দিলে পরিবার পরিজন নিয়ে কি খাব ?’ পাথরঘাটা মাঝি মাল্লা সমিতির সভাপতি সিদ্দিক জমাদ্দার বলেন, ‘অযৌক্তিক এই নির্দেশ মানার প্রশ্নই আসেনা।’ সমিতির সাধারন সম্পাদক এনামুল হোসেন বলেন, ‘একই সমুদ্রে মাছ ধরি আমরা আর ভারতীয় জেলেরা। ভারতে ছোট ছোট মাছের প্রজনন মৌসুমের জন্য বৈশাখ এবং জৈষ্ঠ মাসকে নির্ধারন করে বন্ধ রাখা হয় মাছ ধরা। অথচ আমাদের জন্য এই সময় নির্ধারন করা হয়েছে আষাঢ় এবং শ্রাবন। তাহলে কি আমাদের সমুদ্রসীমায় এসে মাছের প্রজনন মৌসুম বদলে যায় ?’ সাধারন জেলেরা বলেন, ‘ভরা মৌসুমে যদি নিষেধাজ্ঞা দেয়াই হয় তাহলে তা ভারতের সাথে মিলিয়ে দেয়া হোক। নয়তো আমাদের পক্ষে এই নিষেধাজ্ঞা মানা সম্ভব না।
বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল কুমার দাস বলেন, ‘সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থাও সরকারই করবে। এক্ষেত্রে কেউ আইন অমান্য করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’