3:11 pm , May 15, 2019
সাঈদ পান্থ ॥ ঈদকে পূজি করে প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও লঞ্চ স্পেশাল সার্ভিসে বাড়ছে ২০ ভাগ যাত্রী ভাড়া। এদিকে লঞ্চের তুলনায় চাহিদা রয়েছে প্রায় ১০ গুন। তাইতো এবারও ঈদে লঞ্চের কেবিন পেতে লটারি নামের ভাগ্যের খেলার উপর নির্ভর করতে হবে রাজধানী ঢাকা থেকে বরিশালসহ দক্ষিনাঞ্চলের বিভিন্ন রুটের লঞ্চ যাত্রীদের। চলতি সপ্তাহেই লটারীর মাধ্যমে ভাগ্য নির্ধারন শেষে ২০ মে’র পর থেকে ঈদের অগ্রিম টিকিট দেয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছে ঢাকা বরিশাল রুটে চলাচলকারী প্রধান দুই লঞ্চ কোম্পানি সুন্দরবন এবং সুরভি’র কর্তৃপক্ষ। অবশ্য এই দুই কোম্পানির বাইরে কীর্তনখোলা, এ্যাডভেঞ্চার, পারাবত এবং টিপুসহ অন্যান্য লঞ্চগুলো এরইমধ্যে বিক্রি শুরু করেছে ঈদ স্পেশাল সার্ভিসের টিকিট। আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে চলছে এই টিকিট বিক্রি। এদিকে ঈদ উল ফিতরকে সামনে রেখে সরকারী রেটের দোহাই দিয়ে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রস্তুতিও চুড়ান্ত করে ফেলেছে লঞ্চ মালিকরা। মাথাপিছু গড়ে ৫০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়ছে লঞ্চ ভাড়া। ঈদের আগে ৩ জুন থেকে শুরু হয়ে ঈদ পরবর্তি ৭ দিন স্পেশাল সার্ভিস চলবে বলে জানানো হলেও বাড়তি ভাড়া আদায় শুরু হবে ২৫ মে থেকেই। ফলে সাধারন মানুষের গাট থেকে লঞ্চ মালিকদের পকেটে যাবে অতিরিক্ত অন্ততঃ ২০/৩০ কোটি টাকা।
বরিশাল এবং ঢাকার কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতি সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এবারের ঈদে রাজধানীঢাকার সাথে বরিশালসহ দক্ষিনাঞ্চলের ২৮ রুটে যাত্রী পরিবহন করবে শতাধিক লঞ্চ। কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু জানান, ‘ঢাকা-বরিশাল রুটে দীবা সার্ভিসের দুটি ওয়াটার বাসসহ মোট ২৩টি লঞ্চের রুট পারমিট রয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে রোটেশন পদ্ধতির আওতায় উভয় প্রান্ত হতে ৬ থেকে ৭টি করে লঞ্চ চলাচল করলেও ২৩টি লঞ্চের সবগুলোই থাকবে স্পেশাল সার্ভিসের আওতায়। প্রয়োজনে ডাবল সার্ভিস দেবে সেগুলো।’ বরিশাল মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কর্মাসের প্রেসিডেন্ট এবং এ্যাডভেঞ্চার শিপিং লাইন্সের মালিক নিজামউদ্দিন বলেন, ‘ঈদে ঢাকা-বরিশাল রুটে নতুন নির্মিত ক্যাটামেরিন টাইপের লঞ্চ এ্যাডভেঞ্চার-৫ নামবে নদীতে। ঈদে এই নৌ-যানটি দৈনিক ডাবল ট্রিপ দেবে বলে আশা করছি।’ ঢাকা-বরিশাল রুটের এসব নৌ-যানের পাশাপাশি দক্ষিনের অন্যান্য রুটগুলোতেও রোটেশন প্রথা ভেঙ্গে ঈদে স্পেশাল সার্ভিসে নামবে আরো অন্ততঃ শতাধিক নৌ-যান। বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এবার ঈদ যাত্রা সামাল দিতে ঢাকা-বরিশাল এবং ঢাকা-বরিশাল-হুলারহাট-মোড়েলগঞ্জ রুটে নিয়মিত সার্ভিসের ৪টি স্টীমারের পাশাপাশি আরো ২টি জাহাজ যোগ করা হবে স্পেশাল সার্ভিসে। এক্ষেত্রে যাত্রীদের অগ্রিম বুকিং নেয়া শুরু হবে ২২ মে থেকে। বেসরকারী লঞ্চগুলোর অগ্রিম টিকিট বিতরন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুন্দরবন নেভিগেশনের পরিচালক আকতার হোসেন আকেজ বলেন, ‘অগ্রিম টিকিট বিতরন নিয়ে চরম বিপাকে আছি আমরা। বর্তমানে চলছে যাত্রীদের চাহিদা গ্রহন। ১৬ মে পর্যন্ত এই চাহিদা গ্রহন করবো আমরা। তবে বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে লঞ্চগুলোতে থাকা আসনের তুলনায় চাহিদা প্রায় ১০ গুন বেশী। পরিস্থিতি এমন যে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ফলে সিদ্ধান্ত হয়েছে লটারীর মাধ্যমে নির্ধারন হবে অগ্রিম টিকিটের ভাগ্য। ২০ মে’র মধ্যে ওই লটারী সম্পন্ন করে অগ্রিম টিকিট ছাড়া হবে। ঈদ স্পেশাল সার্ভিস শুরু হবে ৩ জুন থেকে। ঈদ পরবর্তি ভীরের চাপ যতদিন থাকবে ঠিক ততোদিনই চলবে স্পেশাল সার্ভিস।’ এক প্রশ্নের জবাবে আকেজ বলেন, ‘ঈদ স্পেশাল সার্ভিসের যাতায়াতে সরকারী রেট অনুযায়ী ভাড়া আদায় করবো আমরা। সেক্ষেত্রে ডেক যাত্রীদের কাছ থেকে বর্তমানের ২০০ টাকার স্থলে আদায় করা হবে ২৫০ টাকা। একইভাবে সিঙ্গেল কেবিন, ডাবল কেবিন, সোফা এবং ভিআইপি’র ক্ষেত্রে গড়ে ৩ শ’ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়বে লঞ্চ ভাড়া।’ ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী সুরভী নেভিগেশনের অন্যতম মালিক রেজিন উল কবির বলেন, ‘সারা বছর সরকারী রেটে লঞ্চের ভাড়া আদায় করা হয়না। যাত্রীদের অসুবিধার কথা ভেবে নির্ধারিত রেটের তুলনায় কম ভাড়া নেই আমরা। তবে ঈদ-কোরবানীতে সেই হারে ভাড়া নেয়া সম্ভব না। ঈদে অনেক বাড়তি খরচ আছে। কর্মচারীদের বোনাস, ঈদের খরচ। তাছাড়া প্যাসেঞ্জার আনতে ডাবল ট্রিপ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবার খালি লঞ্চ চালিয়ে যেতে হয় ঢাকায়। এসব লোকসান পোষাতে সরকারী রেটে ভাড়া আদায় ছাড়া কোন উপায় থাকেনা। তাছাড়া যে রেটে ভাড়া নেয়া হবে তাও তো পুরোপুরি সরকারী রেট নয়। সরকারী রেটে নিতে গেলে ভাড়া আরো বাড়তো।’
লঞ্চ ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডাঃ মিজানুর রহমান বলেন, ‘যাত্রীদের সুবিধা অসুবিধার কথা ভেবে যে তারা সারা বছর ভাড়া কম নেয় তা ঠিক নয়। আসলে বছরের অন্যান্য সময় যাত্রী কম থাকার পাশাপাশি লঞ্চগুলোর মধ্যে থাকে কঠিন প্রতিযোগীতা। ফলে ব্যবসায় টিকে থাকতে ভাড়া কম নেয় তারা। আর ঈদের সময় ঘরে ফিরতে ব্যাকুল মানুষ অনেকটাই জিম্মি থাকে লঞ্চ মালিকদের কাছে। এই জিম্মি দশাকে পূঁজি করেই আদায় করা হয় সরকারী রেটের নামে বাড়তি ভাড়া। ৬ সদস্যের একটি পরিবারকে যদি মাথা পিছু ৫০ টাকা বাড়তি দিতে হয় তাহলে অতিরিক্ত গেল ৩০০ টাকা। আসা-যাওয়ায় ৬০০। নিম্মবিত্ত একটি পরিবারের জন্যে এটি কোন সামান্য টাকা নয়। সরকারের কাছে আবেদন জানাই অন্ততঃ ঈদের সময় যেন সরকারী রেটের প্রয়োগ না হয়। ঘরে ফেরা মানুষ তাতে বিপাকে পড়বে। হয় সারা বছর একই রেটে ভাড়া আদায় নয়তো ঈদে বন্ধ হোক বাড়তি রেটে ভাড়া আদায়।’
বড় বড় লঞ্চ কোম্পানিগুলো অগ্রিম টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে লটারিসহ নানা আয়োজন করলেও ঢাকা-বরিশাল রুটের অন্যান্য লঞ্চ মালিকরা অবশ্য এসবের ধার ধারছে না। ১১ মে থেকে অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু করেছে এ্যাডভেঞ্চার গ্রুপ। এই কোম্পানির মালিকানায় থাকা নৈশকালীন সার্ভিসের দুটি এবং দীবা সার্ভিসের একটি জাহাজের অগ্রিম টিকিট বিক্রি হচ্ছে আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে। এছাড়া কীর্তনখোলা গ্রুপের দুটি লঞ্চেরও অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। একইভাবে টিকিট বিক্রি শুরু করেছে মানামী, পারাবত, যুবরাজ, টিপু, গ্রীনলাইন এবং ফারহানসহ অন্যান্য লঞ্চগুলো। এসব লঞ্চের বুকিং কাউন্টারগুলো থেকে আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে কেবিন দেয়া হচ্ছে বলে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা হচ্ছেনা বলে অভিযোগ সাধারন যাত্রীদের। মুখ চিনে টিকিট দেয়া হচ্ছে এমন অভিযোগ জানান তারা। বিষয়টি সর্ম্পকে জানতে যোগাযোগ করা হলে সরাসরি কিছু স্বীকার না করলেও পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কাউন্টারগুলোতে দায়িত্বরত কর্মচারীরা বলেন, ‘যারা নিয়মিত যাত্রী তাদেরকেই আসলে বেশী গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া নগরীর মুখ চেনা এবং প্রভাবশালীদের অনুরোধ রাখতে হয় সবার আগে। তানাহলে ব্যবসা বানিজ্যে জটিলতা বাধে। এসব কারনে কিছু কিছু যাত্রীরা টিকিট পাচ্ছেনা এটা ঠিক তবে আমাদের কাছে আসা শতকরা ৮০ ভাগ যাত্রীর চাহিদাই পূরন করছি আমরা।’