3:24 pm , April 18, 2019
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ উচ্চ সুদে গ্রাহকদের লগ্নি করা ১৮ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হওয়া নগরীর কাটপট্টির জুয়েলারী ব্যবসায়ী গোপাল কর্মকারের সন্ধান এখনও মেলেনি । ইতিমধ্যে লাপাত্তা গোপালের স্ত্রী এবং দুই কন্যা সন্তান কারাগারে থাকলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে ব্যবসায়ী গোপাল কর্মকার । উচ্চ হারে সুদ দেওয়ার কথা বলে নগরীর প্রায় শতাধিক ব্যক্তির নিকট থেকে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে আত্মগোপনের সপ্তাহ অতিক্রম হতে চললেও পুলিশ কিংবা অন্য কোন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী পলাতক গোপালের অবস্থান সনাক্ত করতে পারেনি। ব্যাবসায়ী ও গ্রাহকরা বলেন, পালাতক হওয়ার পূর্বেই গোপাল সমূদয় অর্থ ভারতে পাঠিয়েছেন। এরপার তিনি বৈধ পথে কিংবা সীমান্ত এলাকা থেকে চোরাই পথে ভারতে প্রবেশ করেছেন। এদিকে টাকা দেয়া গ্রাহকরা পরেছেন চরম বিপাকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে কাটপট্টি রোড এলাকায় জুয়েলারী ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম ছিল গোপাল ও তার ২ ভাইয়ের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অলংকার ভবন নামের দুটি দোকান । ঐ এলাকার মোনলিসা মার্কেটে তারা যৌথভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতো । দীর্ঘদিন যাবৎ পলাতক গোপালের বড় ভাই দীপক কর্মকার ও মেজো ভাই অরুণ কর্মকার এবং গোপাল যৌথভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিলেন । গোপাল পলাতক হলেও তারা অন্য দুই ভাই দীপক কর্মকার এবং অরুন কর্মকার এখনো কাটপট্টি রোড এলাকায় ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন । তাদের মালিকানাধীন দোকান এর বিপরীত দিকে ফরিদা মঞ্জিল গলির মধ্যে নিজস্ব ৫তলা ভবন রয়েছে । যদিও দুই ভাই দাবী করেছেন অলংকার ভবনের সাথে গোপালের কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি ভাই হলেও গোপালের এই অপকর্ম তারা মেনে নেবেন না বলে জানিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাটপট্টি রোড এলাকার একাধিক জুয়েলারি ব্যবসায়ী জানান, যে সকল টাকা নিয়ে গোপাল পালিয়েছে তার উল্লেখযোগ্য অংশ টাকা তার দুই ভাইয়ের কাছে রয়েছে। কিন্তু তার ভাইয়েরা কৌশলে এ ঘটনা থেকে নিজেদের আড়াল করে রেখেছেন। ব্যবসায়ীরা জানান প্রায় ২৫ বছর পূর্বে ফরিদপুর এলাকার ভাঙ্গা উপজেলা থেকে বড় ভাই দীপক কর্মকার এর সঙ্গে বরিশালে ব্যবসা আরম্ভ করেন গোপাল কর্মকার । এর আগে তার বাবা এ এলাকায় অলংকার কর্মী হিসেবে কাজ করতেন বলে জানা গেছে। এরপর ধীরে ধীরে তিন ভাই মিলে আদি অলংকার ও নিউ অলংকার ভবন নামে দোকান তৈরি করেন । পরে একই দোকানে ২ ভাই ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিলেন। এলাকার অন্যান্য ব্যবসায়ীদের তুলনায় তাদের দোকানে বেচা-কেনা, ক্রেতা সমাগম এবং মালামাল বেশি ছিল। যে কারণে সকলের নিকট বড় ব্যবসায়ী হিসেবে আস্থা অর্জন করেছিলেন এ তিন ভাই । স্বর্ণ কেনা-বেচার পাশাপাশি উচ্চহারে সুদের বিনিময়ে টাকা জমা ও লগ্নি করতেন তারা ।এ ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন লোকের নিকট থেকে ২০ হাজার থেকে ৯৫ লাখ টাকা পর্যন্ত গ্রহন করেছেন । তবে কখনই গ্রাহকদের কোন চেক কিংবা ষ্ট্যাম্প দেওয়া হতো না । শুধুমাত্র সিøপের মাধ্যমে টাকা নেওয়া হতো । খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সম্প্রতি অর্ধশত প্রতারিত গ্রাহক কোতয়ালী মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন । তারা সকলেই গত ২/৩ বছরের মধ্যে গোপাল কর্মকার এর নিকট টাকা জমা রেখেছিলেন । ভুক্তভোগী একাধিক গ্রাহক মনে করেন পূর্ব পরিকল্পিতভাবে টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল গোপাল কর্মকার ও তার ভাইদের। যে কারণে অন্য কোন ভাই টাকাপয়সা লেনদেন এ সরাসরি অংশ নেন নি । পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে গোপাল একাই গ্রাহকদের নিকট থেকে টাকা নিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার ভাইরা মিলে যৌথভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতেন এবং একই সাথে বসবাস করতেন। তারা জানান আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থান নিলে গোপাল ফেরত আসবে। কেননা তার স্ত্রী ও ২ সন্তান পুলিশের হাতে আটক থাকার পাশাপাশি বরিশালে তাদের বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে বিলাস বহুল জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল গোপাল । এসকল ব্যাপারে জুয়েলারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলী জসিম জানান গ্রাহকদের সঙ্গে এ সকল লেনদেন গোপনে করা হয়েছে। বিশ্বস্ততার সম্পর্ক থাকায় অনেক গ্রাহক এ ধরনের লেনদেন করে থাকেন । তবে পূর্বে সমিতির লোকজন এ ব্যাপারে অবহিত ছিল না। খোজ নিয়ে জানাগেছে বর্তমানে গোপাল ও তার ২ভাই আদি অলংকার, নিউ অলংকার ভবন ও মোনালিসা জুয়েলার্সের মালিক। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে গোপাল কর্মকার শতাধিক গ্রাহকের কাছ থেকে সুদের বিনিময়ে প্রায় ২০ কোটি টাকা লগ্নি করে। গ্রাহকরা টাকার প্রয়োজনে তাদের পাওনা টাকা ফেরত চাইলে গোপাল বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে টালবাহানা করে। এভাবে সে প্রায় শতাধিক গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকা বড় অংকের সুদের প্রলোভন দেখিয়ে ঋণ নেয় গোপাল। গোপালের চিন্তা ছিলো ওই টাকা আত্মসাত করে পরিবার নিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার। এদিকে গ্রাহকেরা পাওনা টাকা ফেরত না দেয়া ৩৪ জন গ্রাহক সম্প্রতি গোপালের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। ওই ৩৪ জন অভিযোগকারীদের নিকট থেকেই গোপাল প্রায় ৭ কোটি টাকা ধার নিয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে জিডিতে। এরা হচ্ছেন ঃ নগরীর গোবিন্দ সাহার নিকট থেকে ৫ লাখ, বনানী দত্তের নিকট থেকে ২০ লাখ ২৫ হাজার, গোপাল সাহার নিকট থেকে ৫ লাখ ৩৮ হাজার, রিতা পালের নিকট থেকে ৩ লাখ, বন্যা দাসের নিকট থেকে ২৫ হাজার, মিন্টু সরদারের নিকট থেকে ৪ লাখ, প্রদীপ দাসের নিকট থেকে ৭ লাখ, সুকুমারের নিকট থেকে ৫ লাখ, চৈতি দাসের নিকট থেকে ৪৭ হাজার, ইমরান ভূইয়ার নিকট থেকে ৬ লাখ ২৫ হাজার, তুলসী রানির নিকট থেকে ৩ লাখ, রিতা কর্মকারের নিকট থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার, মিনু রানীর নিকট থেকে ১১ লাখ ৫০ হাজার, রাম কৃষ্ণ নিকট থেকে ১ লাখ ২০ হাজার, সুমন লালের নিকট থেকে ৭ লাখ, নীল কমলের নিকট থেকে ২ লাখ, জাফরের নিকট থেকে ১১ লাখ, লুতফুন্নেসা নিকট থেকে ৪২ লাখ, ইমরানের নিকট থেকে ৬ লাখ ২৫ হাজার, বিশ্বনাথের নিকট থেকে ১০ লাখ, সুমন দেবনাথের নিকট থেকে ৩৬ লাখ, নুরুল ইসলামের ১ লাখ ৩৪ হাজার, মিন্টু দাসের ৩৫ লাখ, বিপ্লবের ৬ লাখ ৫০ হাজার, মানবেন্দ্র সাহার ৯৬ লাখ, মাহিনুরের ৯১ লাখ ৯১ হাজার, শাহিনুর ৯ লাখ ৫০ হাজার, রিয়াজের ৬ লাখ, জাকির হোসেনের ৪৬ লাখ, সখিনার ১ লাখ ৪৫ হাজার, সুফিয়া ৩ লাখ ৫০ হাজার, জহিরুলের ২ লাখ ৫০ হাজার ও সোহেলী পারভীনের ১০ লাখ ৯৩ হাজার টাকা ধার নেয়। অভিযোগের ভিত্তিতে গত সপ্তাহে গোপালকে আটক করতে পুলিশ তার বাসায় অভিযান চালায়। খবর পেয়ে গোপাল পালিয়ে যায়। গোপালের স্ত্রী ও মেয়েরা ভারতে পালিয়ে যাবার সংবাদ পেয়ে পুলিশ তাদের আটক করে থানায় নিয়ে আসে। এ সময় প্রায় অর্ধ শতাধিক গ্রাহক থানায় ভিড় জমায়। থানায় অভিযোগকারী গ্রাহক ছাড়াও আরো অনেক গ্রাহক গোপালের স্ত্রী ও দুই মেয়েকে আটকের খবর পেয়ে সেখানে ভিড় জমাচ্ছেন। তারাও নতুন করে গোপালের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেবেন বলে জানান। এদের মধ্যে নগরীর ফিশারী রোডের বাসিন্দা সৈয়দ নোমান জানান, দুই বছর পূর্বে তার মা সৈয়দা লুৎফুন্নেছার নিকট থেকে ৪২ লাখ টাকা সুদে নেন গোপাল। কিছুদিন সুদ দিয়ে আকস্মিক সুদ দেয়া বন্ধ করে দেন। এরপর ওই টাকা ফেরত চাইলে গোপাল কালক্ষেপন করতে থাকেন। তিনি আরো জানান, এভাবে বহু লোক গোপালের নিকট টাকা সুদে দিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। এ ব্যাপারে কোতোয়ালী মডেল থানার ওসি নুরুল ইসলাম জানান, ৩৪ জন গ্রাহকের অভিযোগের ভিত্তিতে মা ও তার দুই মেয়েকে আটক করা হয়েছে। এ ব্যাপারে পুলিশ কোন ছাড় দেবে না বলে কোতোয়ালী ওসি জানান।