3:05 pm , April 12, 2019

রুবেল খান ॥ নগরীতে নির্মিত এবং নির্মানাধীন বহুতল ভবন, হাসপাতাল এমনকি বাজার ঝুঁকিপূর্ন বলে দাবী করছে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ। এসব স্থাপনা নির্মানে যেমন মানা হয়নি ইমারত নির্মান বিধিমালা ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, তেমনি নেই অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা। সম্প্রতি নগরীর হাসপাতাল, বহুতল ভবন ও বাজার সহ ২২০টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা। যার একটি ভবনেও তারা খুঁজে পাননি অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা কিংবা ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষের ভবন নির্মান সংক্রান্ত পুর্ণাঙ্গ অনুমোদনপত্র। তার মধ্যে আবার রয়েছে প্লান বহিভূতভাবে বহুতল ভবন নির্মানের অভিযোগ। যার ফলে ভবন কিংবা স্থাপনাগুলোতে অগ্নিকান্ডের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ও বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার আশংকাও করছেন ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে বহুতল ভবনগুলোর ক্ষেত্রে এমনটি হলে আগুন নিয়ন্ত্রনে হিমশিম খেতে হবে দমকল বাহিনীকে। কেননা বহুতল ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রন বা উদ্ধার কাজের জন্য যা প্রয়োজন তার কিছুই নেই তাদের। বরিশাল ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স পরিদর্শক বাবু ইউসুফ পান্না বলেন, ‘যেখানে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নেই সেখানে ভবন নির্মানের জন্য প্লান অনুমোদন দিয়ে থাকে সিটি কর্পোরেশন। সে অনুযায়ী নগরীর যেসব ভবন নির্মান হয়েছে এবং নির্মানাধীন ভবন রয়েছে সেগুলোর অনুমোদন বরিশাল সিটি কর্পোরেশন থেকেই দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘৬ তলার ওপর ভবন নির্মানের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে থাকে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ। বহুতল ভবন নির্মানে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের অনুমোদনের জন্য আবেদন জানাতে হয় ফায়ার সার্ভিসের দপ্তরে। স্থানীয়ভাবে মাঠ জরিপের প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে ডিজি অফিস প্রাথমিকভাবে ভবন নির্মানের অনুমোদন দিয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, ভবন নির্মান শেষে বসবাসের উপযোগিতার সনদও দিয়ে থাকে ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু নগরীর ক্ষেত্রে এই নিয়ম শুধুমাত্র কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ রয়েছে। কেননা এ পর্যন্ত নগরীতে ৫৪ জন ব্যক্তি ভবন নির্মানের জন্য ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র গ্রহন করেছেন। যার মধ্যে সর্বোচ্চ ১২ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মানের ছাড়পত্র প্রদান করা হয়েছে। ১৪টি ভবন এরই মধ্যে তৈরীও হয়েছে। কিন্তু একটি ভবনের মালিক বসবাস উপযোগিতার সনদ গ্রহন করেননি বলে হতাশা ব্যক্ত করেন ফায়ার সার্ভিসের ওই পরিদর্শক।
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা ২২০টি ভবন ও শপিং কমপ্লেক্স পরিদর্শন করেছি। যার মধ্যে ৭৫টি হাসপাতাল, ২৪টি ব্যাংকের ৯০টি শাখা প্রতিষ্ঠান, ১৪টি বহুতল ভবন ও ছোট বড় মিলিয়ে ৪১টি শপিংমল। এসব প্রতিষ্ঠান মালিকদের কাছে ভবনের লে আউট প্লান, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর কর্তৃক ভবনের অনুমোদিত ফায়ার সেফ্টি প্লান, অনাপত্তি ছাড়পাত্র, অনুমোদিত অকুপেন্সি সার্টিফিকেট ও ফায়ার ইভাকুয়েশন ড্রিল (মহড়া) প্রশিক্ষ রেজিষ্টার দেখতে চাওয়া হয়েছে। দুঃখজনক হলো এটাই যে ভবনের লে আউট প্লান ছাড়াও একটি ভবনের মালিকও বাকি চারটি’র একটি প্লান বা অনুমোদন এবং ছাড়পত্র দেখাতে পারেনি। কোন কোন ভবনে লে আউট প্লানও পাওয়া যায়নি। যার কারনে প্রতিটি ভবনই অগ্নিনিরাপত্তার প্রশ্নে ঝুঁকিপূর্ণ। এসব কারনে নগরীর আবাসন ব্যবস্থাও ক্রমশই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
অপরদিকে বরিশাল ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স এর সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, ‘বরিশাল নগরীতে একের পর এক বহুতল ভবন নির্মান হচ্ছে। এরই মধ্যে নগরীতে ৯ তলার ওপরে ১২ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মান হয়েছে। শুনেছি ১৫ তলা ভবনের প্লান অনুমোদনও হয়েছে। একটা সময় এটা বরিশাল ফায়ার সার্ভিসের জন্য দুশ্চিন্তার কারন হয়ে দাড়াতে পারে। এর কারন উল্লেখ করে মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের যতটুকু সক্ষমতা রয়েছে তাতে সিরিজ পাম্প দিয়ে সর্বোচ্চ ৭/৮ তলা অথাৎ ৫৪ মিটার উঁচু ভবনের আগুন নেভানো সম্ভব হবে। এর ওপরে আগুন লাগলে ট্রান টেবিল ল্যাডার (টিটিএল) প্রয়োজন হবে। যা আমাদের নেই।
তাছাড়া আমাদের বরিশালে এক্সটেনশন ল্যাডার (মই) রয়েছে। তাও আবার হাইড্রোলিক নয়, ম্যানুয়াল। যা দিয়ে সর্বোচ্চ ৪ তলা পর্যন্ত উদ্ধার তৎপরতা সম্ভব। রাজধানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডের পরে উদ্ধার অভিযানে যতটা বেগ বেতে হয়েছে তা শুধুমাত্র এক্সটেনশন ল্যাডার (মই) এর কারনেই। তাই বরিশালে এমনটি হলে সে ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের তাকিয়ে থেকে দেখা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।
ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স এর সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন সিকদার বলেন, ‘আমরা বরিশালে একটি ভবন খুঁজে পাইনি যেটা অগ্নিকান্ডের প্রশ্নে ঝুঁকিমুক্ত। বলতে গেলে প্রতি মাসেই আমরা এসব ভবন মালিকদের চিঠি দিয়ে শতর্ক করছি। কিন্তু ভবন মালিকরা আমাদের চিঠির কর্ণপাত করছে না। আর আমাদেরও এর বাইরে কিছু করার ক্ষমতা নেই। আমরা শুধু শতর্ক করতে পারি। ব্যবস্থা গ্রহনের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। তারা চাইলে ভবন সিলগালাও করে দিতে পারে। কিন্তু বরিশালের ক্ষেত্রে এমনটি কখনই ঘটেনি।
ফারুক হোসেন সিকদার বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ প্লান অনুমোদন করে থাকে। তারা ভবনের সেফটি ও অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টিতে একটু গুরুত্ব দিলেই এ সমস্যা সমাধান সম্ভাব। সেই সাথে সাধারণ মানুষের সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। এতে করে বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেও এই কর্মকর্তা।
এ প্রসঙ্গে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্লানিং শাখার স্থপতি হৈমন্তি শুকলা বসু বলেন, বিগত ১০ বছরের ব্যবধানে নগরীতে সংখ্য বহুতল ভবন গড়ে ওঠে। বর্তমানে এর সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি হবে। সর্বশেষ ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৯৬৫টি ভবনের প্লান অনুমোদন করা হয়েছে। যার মধ্যে ৭ থেকে ১৫ তলা পর্যন্ত ৯২টি। ১৪ ও ১৫ তলা পর্যন্ত ২টি, ১০ তলা ৫টি, ৯ তলা ৫৪টি, ৮ তলা ১৪টি ও ৭ তলার ১৭টি প্লাস পাশ করা হয়েছে। যার মধ্যে নগরীর চৌমাথায় পনেরতলা ভবন নির্মান কাজ সম্প্রতি শুরু হয়েছে। সিএন্ডবি রোডে নির্মানের অপেক্ষায় আছে এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হাই এর ১৪ তলা ভবনটি। তিনি বলেন, ‘আমাদের মনিটরিং সেল নেই। যে কারনে প্লান অনুমোদনের পরে তা পুনরায় মনিটরিং করে দেখা সম্ভব হচ্ছে না। অবশ্য প্লান অনুমোদনের ক্ষেত্রে আমরা ফায়ার সার্ভিস থেকে দেয়া অনুমোদন ও ছাড়পত্রের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। তবে একভাবে প্লান অনুমোদন করিয়ে নিলেও পরে সেভাবে কাজ হয় না বলে অভিযোগ করে হৈমন্তি সুকলা বসু বলেন, ‘অধিকাংশ ভবন মালিকের বিরুদ্ধেই অনুমোদনের থেকে দু-একতলা বেশি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে স্থানীয়ভাবে মনিটরিং এর জন্য সম্প্রতি আমরা একটি তদারকি কমিটি করেছি। যাদের মাধ্যমে অনিয়মগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যেটাতে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।