3:10 pm , April 9, 2019
রহিম রেজা, রাজাপুর ॥ রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের স্মৃতি বিজরিত ঝালকাঠির ঐতিহ্যবাহি ধানসিঁড়ি নদী পুনঃখননে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান স্কেভেটর মেশিন দিয়ে নদীর দু’পাড় থেকে মাটি ছেঁটে পাড়েই এমন ভাবে রাখা হচ্ছে যে, বর্তমান বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি হলেই মাটি ধুয়ে পূনরায় নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে, ছাড়া এখনই খননকৃত নদীর পাড় ভেঙে মধ্যে পড়ছে এবং মাঝে মাঝে বাধ রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে চুক্তির শর্তের ব্যাপারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কোন ছাড় দেয়া হবে না।
ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, প্রধানমন্ত্রীর ডেলটা প্লান অনুযায়ী ৬৪ জেলার অভ্যন্তরস্ত ছোট নদী খাল খনন প্রকল্পের আওতায় রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের প্রিয় ঝালকাঠি জেলার ধানসিঁড়ি নদীটি ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ২ বছর মেয়াদে দুই কিস্তিতে সাড়ে ৮ কিলোমিটার পুনঃখননের জন্য প্রায় ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ ঐতিহ্যবাহি নদীটির ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাবখান নদীর মোহনা থেকে দেড় কিলোমিটার বাদ দিয়ে খনন কাজ শুরু করে রাজাপুর উপজেলার বাগড়ি বাজারের জাঙ্গারিয়া নদীর মোহনা পর্যন্ত মোট সাড়ে ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে নদীটির ৪ লাখ ১৬ হাজার ৮০৬.৫ ঘ. মি. মাটি খনন করা হবে। প্রকল্পের শর্তানুযায়ী নদীর তলদেশ থেকে মাটি কেটে পাড় থেকে দুরে রাখতে হবে এবং বতর্মান নদীর তীর বা চর/সমতল থেকে নদীর গভীরতা হতে হবে সাড়ে ১৫ ফুট (৪.৭ মিটার) এবং উপরের প্রস্থ্য প্রায় ৭০ ফুট এবং গভীর/তলদেশে প্রস্থ ২০ ফুট। এ কাজের জন্য মনোনিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ঢাকার পুরানা পল্টনের আরএবি-পিসি (প্রাঃ) লিঃ-পিটিএসএল ও মৈত্রী (প্রাঃ) লিঃ কে ২০১৯ সালের ১১ মার্চ কার্যাদেশ প্রদান করেন এবং চলতি বছরের ১২ মার্চ কাজ শুরু এবং ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল সম্পন্ন করার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়। সরেজমিনে ধানসিঁড়ি নদী খনন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাগড়ি বাজার ব্র্যাক এলাকা থেকে ২টি স্কেভেটর মেশিন দিয়ে এবং গাবখান নদীর মোহনা এলাকা থেকে ২টি স্কেভেটর মেশিন দিয়ে খনন কাজ শুরু করলেও কয়েকদিন পর গাবখান মোহনা এলাকার ২টি স্কেভেটর মেশিনে ত্রুটির কারনে এখন মাত্র ২টি স্কেভেটর মেশিন দিয়ে খনন কাজ চলছে। খনন কাজ তদারকির জন্য কাউকে দেখা যায়নি।
স্থানীয় একাধিক কৃষক ও এলাকাবাসী অভিযোগ করে জানান, ধানসিড়ি নদীর খনন কাজ শুরুর হওয়ার পর খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু কাজের মানে হতাশ হলাম। কারন খনন কাজ শুরু থেকেই দু’পাড় থেকে স্কেভেটর মেশিন দিয়ে মাটি ছেঁটে ও চাপিয়ে পাশে রেখে নদী তীরের উচ্চতা বাড়ানো হচ্ছে। নদীর উপরের চওড়া বা দৈঘ্য ৭০ ফুট করার নিয়ম থাকলে করা হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৪ ফুট। তীর বা সমতল থেকে সাড়ে ১৫ ফিট গভীর করার নিয়ম থাকলে বাস্তবে করা হচ্ছে সাড়ে ১০ ফিট। গভীরতার প্রস্থও সঠিকভাবে হচ্ছে না। পাড় থেকে দূরে মাটি রাখার নিয়ম থাকলে মাটি উঠিয়ে খনন কাজের পাশে মাটি রাখার কারনে চলমান বর্ষা মৌসুমে তা ধুয়ে পুনরায় নদীটি ভরাট হয়ে যাওয়ার আশংকা করছে কৃষক ও এলাকাবাসী। ছাড়া এখনই খননকৃত নদীর বিভিন্ন স্থানের পাড় ভেড়ে মধ্যে পড়ছে এবং মাঝে মাঝে বাধ রাখা হচ্ছে, যা কয়েক মাসের মধ্যেই পুনরায় খননকৃত নদীটি ভরাট হয়ে যাবে। এভাবে কোনমতে খনন কাজ শেষ করে পানি ছেড়ে নেয়া হবে বলেও শঙ্কা স্থানীয়দের। এতে বিপুল অর্থ ব্যয়ে বাস্তবায়িত প্রকল্পটির উদ্দেশ্য সফল হওয়া নিয়ে স্থানীয়রা সংশয় প্রকাশ করেছেন। পানি উন্নয়ন বিভাগের পক্ষ থেকে সঠিকভাবে তদারকিও করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীটি সর্বশেষ ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রায় ৮৪ লাখ টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডে রাজাপুর অংশের পিংড়ি-বাগড়ি-বাঁশতলার মোহনা পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটার খনন করোিছল। সঠিকভাবে খনন করা এবং নিয়মিত বরাদ্দ না দেওয়ার কারনে পরের ৪ কিলোমিটার খনন করার এ কারনে খননকৃত অংশও পুনরায় ভরাট যায়। এসব কারনে নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে নাব্য না থাকায় অর্থনৈতিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্থ হয় এ জনপদের মানুষ। এ কারনে কয়েকটি গ্রামে দেখা দেয় তীব্র পানি সংকট, কৃষি কাজ ব্যাহত হয়। বর্তমানে নদীটি বাধ দিয়ে খনন কাজ করায় নদীটির আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামে পানি সংকট চরম আকার ধারন করেছে। রূপসী বালার কবি জীবনানন্দ দাশ ধানসিঁড়ি নদী নিয়ে তার কবিতায় লিখেছিলেন, আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শংখচিল শালিখের বেশে….। ঐতিহ্যবাহি এ ধানসিড়ি নদীটি খনন গুরুত্বসহকারে তদারকি ও সঠিকভাবে খনন কাজ সম্পন্ন করার দাবি এলাকাবাসীর।
নদী খননের মাটি কাটার শ্রমিকরা জানান, ঠিকাদারের নির্দেশ ও নিয়ম মত কাজ করছেন হচ্ছে। তলদেশ ২০ ফিট, চওড়া করা হচ্ছে ৭০ ফিট, গভীর করা হচ্ছে পানির লেভেল থেকে ৬/৭ ফিট। ৭০ ফুটের বাহিরে মাটি ফেলা হচ্ছে এবং বর্ষা যাতে মাটি ভেঙে না পড়ে সেজন্য মেশিন দিয়ে চাপ দিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং খনন কাজ শেষে বাধ তুলে দেয়া হবে।
ঠিকাদার মোঃ মনিরুজ্জামান হাওলাদার সমকালকে বলেন, খনন কাজ চলছে, সে সকল ত্রুটি বা সমস্যা রয়েছে তা সম্পূর্ণ সমাধান করা হবে, খনন কাজে কোন অনিয়ম হবে না। শতভাগ সঠিক নিয়মে খনন কাজ সম্পন্ন হবে। তিনি বলেন, খনন কাজ শেষ হোক ১৫ দিন পরে ডিসি স্যারসহ সাংবাদিকরা সকলে এসে দেখবেন সারাদেশের চেয়ে ভাল কাজ হয়েছে।
ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এস.এম. আতাউর রহমান সমকালকে জানান, ধানসিড়ি নদীটির সাড়ে ৮ কিলোমিটার খনন প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছে। খনন করে নীদর পাড়ে রাখা মাটি সরিয়ে রাস্তা সংস্কার ও বনায়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। কিছু স্থানে মাটি ভেঙে পড়ছে এবং ক্রোস বাধ রয়েছে তা সরিয়ে খালটি যাতে সঠিকভাবে খনন করা হয় যে জন্য কোন অনিয়ম মেনে নেয়া হবে না এবং খননের সকল শর্তের ব্যাপারে কোন প্রকার ছাড় দেয়া হবে না। এছাড়া খনন কাজ সঠিকভাবে তদারকি করা হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। খননের পর মেপে যে টুকু মাটি কাটা হয়েছে, সে অনুযায়ী বিল পাবে। কোন অনিয়ম বা দুর্নীতি করার সুযোগ নেই।
ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক মোঃ হামিদুল হক জানান, ইতোমধ্যে ধানসিড়ি খনন কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আগামী ৪০/৫০ দিনের মধ্যে খনন কাজ সম্পন্ন হবে। নদীর দু’পাশে বসতি থাকায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে, তাও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করে খনন কাজ চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের উপর পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং জেলা প্রশাসনের কঠোর নজরদারি ও তত্ত্বাবধায়ন রয়েছে, যাতে নদীটি সঠিকভাবে খনন কাজ সম্পন্ন করা হয়। নদীটি খনন কাজ সম্পন্ন হলে এই এলাকার কৃষক সম্প্রদায়ের সেচ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাফল্য বয়ে আসবে এবং রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের স্মৃতি বিজরিত ধানসিঁড়ি নদীটি রক্ষা পাবে।