3:07 pm , March 27, 2019
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ রাষ্ট্রীয় জাহাজ চলাচল প্রতষ্ঠান-বিআইডব্লিউটিসি অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রীবাহী নৌযান ‘এমভি মধুমতি’র সাহায্যে ঢাকা-মোংলা-কোলকাতা রুটে একটি পরীক্ষামূলকভাবে সার্ভিস পরিচালন শুরু করতে যাচ্ছে শুক্রবার। দুই দেশের সরকার প্রধানের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে প্রায় ৭০ বছর পরে আন্তঃদেশীয় নৌপথে এ যাত্রীবাহী সার্ভিসের পরীক্ষামূলক পরিচালন-এর আনুষ্ঠানিক সূচনা হতে যাচ্ছে। ১৮৭৪ সালে এ উপমহাদেশে বাস্পীয় প্যাডেল জাহাজ চালু করে বৃটিশ আইজিএন এবং আরএসএন কোম্পানী। দেশ বিভাগের পরে ১৯৪৮ সালে ভারত-বাংলাদেশ নৌযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে বৃটিশ-ভারতের ‘আইজিএন’ ও ‘আরএসএন কোম্পানী’র কয়লা চালিত বাস্পীয় প্যাডেল হুইল জাহাজের সাহায্যে বরিশাল থেকে কোলকাতা রুটে যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযান পরিচালিত হত। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের নৌযানও বরিশাল-কোলকাতা রুটে পরিচালতি হত। কিন্তু সুন্দরবনের গহীন অরন্যে তাদের একটি নৌযান ডুবির প্রেক্ষিত তা বন্ধ হয়ে যায়। বৃটিশ ব্যক্তি মালিকানাধীন ‘ফ্লোটিলা নেভিগেশন’র নৌযানও এ নৌপথে যাত্রী পরিবহন করত দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত।
কিন্তু দেশ বিভাগের পরে এ সব সার্ভিসই বন্ধ হয়ে যায়। পরিবর্তীতে নারায়নগঞ্জ ও বরিশাল হয়ে রকেট স্টিমারের সাথে খুলনা থেকে কোলকাতাগামী ট্রেনের সংযোগ চালু ছিল ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ পর্যন্ত। নারায়নগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দমুখী স্টিমারের সাথে কোলকাতাগামী ট্রেনেরও সংযোগ সার্ভিস চালু ছিল ঐ যুদ্ধপূর্ব সময় পর্যন্ত। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকলের আওতায় কোলকাতা থেকে আংটিহারা-মোংলা-বরিশাল হয়ে ভারতের আসামের ডিব্রুগর পর্যন্ত পণ্যবাহী নৌযানের চলাচল অব্যাহত রয়েছে। নতুন করে ভারত-বাংলাদেশ যাত্রীবাহী নৌযান চালু উপলক্ষে সব প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। শুক্রবার সন্ধা ৭টায় ঢাকার পাগলা ঘাট থেকে বিআইডব্লিউটিসি’র এমভি মধুমতি যাত্রা শুরু করবে। এ উপলক্ষে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ও নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন। ঢাকার পাগলা ঘাট থেকে ছেড়ে পথিমধ্যে নৌযানটি শনিবার বিকেলে মোংলা বন্দর হয়ে পুরনো চালনা অতিক্রম করে সুন্দরবনের মধ্যেভাগ দিয়ে আংটিহারা’তে কাষ্টম ও ইমিগ্রেশনের সব আনুষ্ঠনিকতা স¤পন্ন করবে। অদূরে ভারত নৌ সীমান্তে প্রবেশ করবে। রবিবার সন্ধ্যা নাগাদ বাংলাদেশী পতাকাবাহী নৌযানটি কোলকাতার হাওড়া এলাকার ঘাটে পৌঁছার কথা রয়েছে। তবে কোলকাতাগামী এ নৌযানটি বিভাগীয় সদর ও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্বম বরিশাল বন্দরে যাত্রা বিরতি করছেনা। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুদ্ধ দক্ষিণাঞ্চলের সাধারন মানুষ। ফিরতি পথে নৌযানটি সোমবার দুপুরে কোলকাতা থেকে রওয়ানা হয়ে অনুরূপভাবে আংটিহারা’তে সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে মোংলা হয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধা নাগাদ ঢাকায় পৌঁছার কথা রয়েছে। পরীক্ষামূলক এ প্রথম যাত্রায় পররাষ্ট্র এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ছাড়াও বিআইডব্লিউটিসি ও বিআইডব্লিউটিএ’র উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগন নৌযানটিতে থাকছেন। তবে পরীক্ষামূলক এ যাত্রায় সিমিত কিছু সাধারন যাত্রীর ভ্রমনের সুযোগও থাকছে বলে বিআইডব্লিউটিসি’র দায়িত্বশীল সূত্রে বলা হয়েছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হয়েছে। ফলে প্রতিদিনই বিপুল সংখ্যক যাত্রী সংস্থাটির রকেট রিজার্ভেশন ও ঢাকা ঘাট সহ বিভিন্ন কর্মকর্তদের টেলিফোন করলেও সব আগ্রহী যাত্রীর জন্য এ নৌযানে ভ্রমনের সুযোগ থাকছেনা। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে পররাষ্ট্র ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
তবে ইতোমধ্যে এ রুটে যাত্রী ভাড়াও নির্ধারন করা হয়েছে। ভ্রমণ কর বাদে দুই শয্যার ফ্যামিলি কেবিন বা ভিআইপি স্যুটের ভাড়া নির্ধারন করা হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। প্রথম শ্রেণীর দুই শয্যার ভাড়া দশ হাজার এবং একক শয্যার কক্ষের ভাড়া ৫ হাজার নির্ধরিত হয়েছে। এর বাইরে ১৫% ভ্যাট ও ৫শ’ টাকা করে ভ্রমন করও পরিশোধ করতে হবে সব যাত্রীকে। ডেক ভাড়া থাকছে দেড় হাজার টাকা। তবে ডেকের যাত্রীদের জন্য ভ্যাট না থাকলেও ভ্রমন কর ৫শ টাকা পরিশাধ করতে হবে।
২০১৫ সালে প্রায় ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সাড়ে ৭শ’ যাত্রী বহনক্ষম ‘এমভি মধুমতি’ নৌযানটির যাত্রী বহন ক্ষমতা সাড়ে ৭শ‘। প্রায় ২৪৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪১ ফুট প্রস্থ নৌযানটির দোতালায় ৪টি ভিআইপি কক্ষে ৮ জন, ১৮টি দুই শয্যার প্রথম শ্রেণীর বাতানুকুল কক্ষে ৩৬ জন ও ৪টি একক শয্যার কক্ষে ৪ জন যাত্রী ভ্রমনের সুবিধা রয়েছে। এছাড়া তৃতীয় তলায় ১৬টি দুই শয্যার কক্ষে ৩২ জন ও ১৮টি সেমি ডবল কেবিনে সম পরিমান যাত্রী ভ্রমন সুবিধা রয়েছে। ৫.২৪৮ ফুট লাডেড ড্রাফটের দ্বিস্তর তলা বিশিষ্ট এ নৌযানটিতে ২শ টন পণ্য পরিবহনেরও সুবিধা রয়েছে। জাপানের ইয়নমার ব্রান্ডের ১১৮৪ অশ্বশক্তির দুটি করে ইঞ্জিন সমৃদ্ধ এ নৌযানটি ঘন্টায় ১১ নটিক্যাল মাইল বা ২০.৩৭ কিলোমিটার নৌপথ অতিক্রমে সক্ষম বলে বিআইডব্লিউটিসির দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে। তবে প্রায় ১২শ টন ওজনের এ নৌযানটি অতিরিক্ত জ্বালানী ব্যয় ও যাত্রীবান্ধব না হওয়ায় তাতে ভ্রমনে এ পর্যন্ত যাত্রীদের তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়নি। ফলে প্রায় ৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘এমভি বাঙালী ও এমভি মধুমতি’ নৌযান দুটি যথাক্রমে ২০১৪-এর এপ্রিল ও ২০১৫-এর মে মাসে চালু হলেও গত ডিসেম্বর পর্যন্ত তার পরিচালন লোকসান প্রায় ১৫ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। ফলে এসব নৌযান সংস্থাটির জন্য ইতোমধ্যে দুঃশ্চিন্তার বিষয়ে পরিনত হয়েছে। তবে ‘ইলেক্ট্রো-হাইড্রেলিক স্টিয়ারিং সিস্টেম’র অত্যাধুনিক ব্রীজ ইকুইপমেন্ট সম্বলিত ‘এমভি মধুমতি’ অভ্যন্তরীন যাত্রী পরিবহন থেকে প্রত্যাহার করে আন্তঃদেশীয় সার্ভিসে নিয়োজিত করায় লোকসান কতটুকু হ্রাস পাবে সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষ এখনই কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।