3:53 pm , March 11, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি মো. কবির সিকদারকে হত্যার অভিযোগ করেছেন তার স্ত্রী হনুফা বেগম। গতকাল সোমবার বেলা সাড়ে ১২টায় বরিশাল প্রেসক্লাবের হল রুমে সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ করেন। এ সময় কবির সিকদার হত্যার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবী জানান প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নিকট। তার আগে গত ৭ মার্চ নিহতের স্ত্রী ২ সন্তানের জননী ও মাস্টার্স ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী হনুফা বেগম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বরাবর ডাক যোগে একটি লিখিত অভিযোগপত্রও পাঠিয়েছেন। এই ঘটনায় মামলা করবেন বলেও জানিয়েছেন এই গৃহবধূ। এদিকে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে অশ্রুসিক্ত নয়নে আবেগ আপ্লুত হয়ে গৃহবধূ হনুফা বেগম কারাগারে আসামীদের জীবনের নিরাপত্তার নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন আমার স্বামী কবির সিকদার তার দুই শিশু সন্তান মাইসুনা (৫) ও ১০ মাস বয়সী ছোট মেয়ে মাইষাকে খুবই ভালোবাসতেন। এরা দু’জন ছিলো তার কলিজার টুকরা। জেল গেটে কণ্যা সন্তানদের নিয়ে যখনই দেখা করতেন যেতাম তখনই তিনি আমাদের সাহস যোগাতেন। কথা ছিলো কয়েকদিনের মধ্যে তাকে আদালতের মাধ্যমে জামিনে মুক্ত করে আনার। কিন্তু তার আগেই আমার স্বামীর মৃত্যু হলো। এখনো ওরা জানে না যে ওদের বাবা এই দুনিয়াতে আর নেই। আমি আমার সন্তানদের এখন কি বুঝ দিবো ? ওদের বাবার অভাব আমি কি দিয়ে পুরন করবো ? এমন প্রশ্ন তুলে সংবাদ সম্মেলনে কেঁদে ফেলেন গৃহবধূ হনুফা বেগম। তিনি দাবী করে বলেন, যিনি সব সময় আমাদের শান্তনা দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন তিনি কখনোই আত্মহত্যা করতে পারে না। তাকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ তুলে হনুফা বেগম বলেন, ঘটনার দিন গত ২৮ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার স্বামী কবির সিকদারের সাথে দেখা করতে সন্তানদের নিয়ে কারাগারে যাই। ওইদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ৫ বার দেখা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওইদিন কারাগারের লোকেরা কবির সিকদারের সাথে আমাকে দেখা করতে দেয়নি। কখনো তারা আমাদের জানায় যে টিকিট হারিয়ে ফেলেছি আবার কখনো বলে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এর পর বিকাল ৪টার দিকে কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে জানায় কবির সিকদার অসুস্থ হয়ে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এমন খবরে পরিবারের সকল সদস্য হাসপাতালে ছুটে গেলে সেখানে থাকা কারারক্ষিরা আমাদেরকে মর্গের দিকে নিয়ে যায় এবং কবির সিকদার কারাগারে আত্মহত্যা করেছে বলে জানায়। হনুফা কারা কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ তুলে বলেন, আমার স্বামী যদি সকালেই অসুস্থ হয়ে থাকে তবে আমাদেরকে সেটা জেলগেটে কেন জানানো হলো না। নাকি আমার স্বামীকে কারাগারে হত্যার পরে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিয়েছে। আর আত্মহত্যার জন্য জেল খানায় কি আলাদা কোন জায়গা রয়েছে ? যেখানে পুলিশের নজর পড়ে না ? নাকি তারা দেখেও না দেখার ভান করেছেন বলে প্রশ্ন তোলেন এই গৃহবধূ। তিনি দাবি করে বলেন, নিহতের শরীরের ডান ও বাম হাতের বাহুর উপরে ও বুকে কালো দাগ রয়েছে। এই দাগগুলো তার মৃত্যু নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। যদি আত্মহত্যাই হয়ে থাকে তবে এই দাগগুলো কিভাবে আসলো। তাছাড়া তার ময়না তদন্তের প্রতিবেদন এমনকি সুরতহাল রিপোর্টও আমাদের দেয়া হয়নি। পুলিশ আমাদের লাশ নেয়ার জন্য জোর করে স্বাক্ষর রেখেছে।
এদিকে হনুফা বেগম বলেন, ১৯৯৯ সালে ভোলার মনপুরা থানায় একটি চুরির মামলায় ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর নিজ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন কবির সিকদার। ওই মামলায় তার ১০ বছরের সাজা দেন ভোলা চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। ভোলা থেকে প্রথমে তাকে পিরোজপুর জেলে এবং পরবর্তীতে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়।
মৃত্যুর ঘটনার এক সপ্তাহ পূর্বে পরিবারের সদস্যরা তার সাথে দেখা করেন। ১৪ মাস কারাভোগের পর গত ৫ মার্চ তার জামিন হওয়ার কথা ছিলো। তাছাড়া একজন কারারক্ষির মাধ্যমে আমরা সব সময় কবির সিকদারের সাথে কথা এবং খোঁজ খবর নিয়েছি। যে লোক ১৪ মাস জেলখানায় রইলো সে কিভাবে আর কয়েকটা দিন ধৈর্য্য ধরতে পারলো না’ বলেও প্রশ্ন করেন নিহতের স্ত্রী।
এদিকে সংবাদ সম্মেলনে করা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল বিভাগের ডিআইজি (প্রিজন) মো. তৌহিদুল ইসলাম এর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি ছুটিতে আছি। এটি যেহেতু বরিশাল কারাগারের বিষয় তাই জেল সুপারের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।
বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার ইউনুস জামান বলেন, এই মৃত্যু নিয়ে সন্দেহের কিছু নেই। কয়েদি কবির সিকদার আত্মহত্যাই করেছে। এ নিয়ে কোন রহস্য নেই। তার পরেও ময়না তদন্ত রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর অন্য কোন কারন থাকলে তা জানা যাবে। অপরদিকে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার প্রসান্ত কুমার বনিক বলেন, যিনি সংবাদ সম্মেলন করেছেন তার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। তাই তিনি অভিযোগ করতেই পারেন। তবে যে অভিযোগ করেছেন তা সত্যি নয়। কয়েকদি কবির সিকদারের শরীরে কোন আঘাতের দাগও আমরা দেখিনি। তাছাড়া একজন ম্যাজিস্ট্রেট মৃত দেহের সুরতহাল করেছেন। তাই ময়না তদন্ত প্রতিবেদন পেলে বিষয়টি বোঝা যাবে। তাছাড়া তিনি বলেন, কারাগারে আত্মহত্যার ঘটনায় কারা অধিদপ্তর থেকে ৩ সদস্য বিশিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিতে ডিআইজি প্রিজনকে আহ্বায়ক এবং একজন জেল সুপার ও একজন জেলারকে সদস্য করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই তদন্ত টিম বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে আসবেন বলে জানিয়েছেন সিনিয়র জেল সুপার। উল্লেখ্য, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিভিশন ভবনের রান্না ঘর থেকে চুরি মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার জামিরতলা গ্রামের দলিল উদ্দিন সিকদারের ছেলে কয়েদি কবির সিকদারের লাশ উদ্ধার করা হয়। সে কারাগারে ঝাড়– দফা হিসেবে কর্মরত ছিলো। কারাকর্তৃপক্ষের দাবী কয়েদি কবির সিকদার (কয়েদি নং-৫৩২৯/এ) কারাগারের গামছা দিয়ে গলায় ফাঁস তিয়ে আত্মহত্যা করেছে।