3:12 pm , February 24, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ চাহিদানুযায়ী কোন ঘাটতি না থাকলেও বিতরণ ও সরবরাহ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে বরিশাল মহানগরী সহ দক্ষিণাঞ্চলের বেশীরভাগ এলাকায়ই বিদ্যুৎ নিয়ে যথেষ্ঠ সংকটে আছেন সাধারন মানুষ। জরুরী চিকিৎসা সেবা সহ পানি সরবরাহ এবং শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোও যথেষ্ঠ বিপর্যয়ের মুখে। তাপমাত্রার পারদ ওপরে ওঠার সাথে বিদ্যুৎ সংকটও বাড়ছে। অথচ কোন ঘাটতি নেই। আসন্ন গ্রীষ্মের গরমের সাথে রমজানে দূর্ভোগ কোন পর্যায়ে পৌঁছবে তা নিয়ে আতংক আছে সাধারণ মানুষের মাঝেও। এমনকি এবার সাম্প্রতিক কালের তীব্র শৈত্যপ্রবাহের মধ্যেই মহানগরীর অনেক এলাকাতেই বিদ্যুৎ নিয়ে দূর্ভোগে পড়তে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। শীত বিদায়ের পরে বসন্তের ভরা মৌসুমেই বিদ্যুৎ নিয়ে জনগনের দূর্ভোগ ক্রমশ বাড়ছে। সরবরাহ ও বিতরন ব্যবস্থার আধুনিকায়নে ঘাটতি সহ দায়িত্বশীলদের কর্তব্যে উদাসীনতা আর জনবল সংকটে পরিস্থিতি ক্রমশ নাজুক পর্যায়ে পৌঁছছে। সাথে রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগও। বেশীরভাগ সময়ই কোন পূর্ব ঘোষনা ছাড়াই একাধিক ফিডার ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকছে। ফলে মানুষের দূর্ভোগ সব সীমা অতিক্রম করছে। এখনো ‘আকাশে মেঘ জমলে বরিশাল মহানগরী অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়’ এ প্রবাদ বাস্তব সত্যি।
দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলায় গতকাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল প্রায় ১৩৫ মেগাওয়াট। আসন্ন গ্রীষ্মে তা ১৬৫ মেগাওয়াট পর্র্যন্ত পৌঁছবে বলে আশা করছেন কর্তৃপক্ষ। গতকাল পর্যন্ত বিদ্যুতের কোন ঘাটতি ছিলনা সারা দেশের মত দক্ষিণাঞ্চলেও। পুরনো বিতরন ও সরবরাহ ব্যবস্থার সাথে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সাধারণ মানুষের দূর্ভোগ ক্রমশ বাড়ছে। খোদ বরিশাল মহানগরীর প্রায় সব ১১ ও .০৪ কেভি বিতরন লাইনগুলো ৩০ বছরেরও বেশী পুরনো। অনেক বিতরন ট্রান্সফর্মারই ওভারলোডেড হয়ে আছে। এসব ট্রান্সফর্মার-এর তেল পরিবর্তন সহ নিয়মিত রক্ষনাবেক্ষন হচ্ছে না। আসন্ন গ্রীষ্মে আরো অধিক সংখ্যক ট্রান্সফর্মারই ওভারলোডেড হয়ে পুড়ে যাবার আশংকাও রয়েছে।
তবে সাম্প্রতিককালে পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার দায়িত্বে নিয়োজিত ‘ওজোপাডিকো’ প্রায় দু হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি ভিন্ন প্রকল্পের আওতায় বিতরণ ও সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নয়নে কাজ করছে। এর আওতায় বরিশাল মহানগরী সহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলা সদর ও কয়েকটি উপজেলা সদরে বিদ্যুৎ বিতরণ ও সরবরাহ ব্যবস্থার কিছু উন্নয়ন কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় মহানগরীর মূল রূপাতলী ৩৩ কেভি সাব-স্টেশনটির পূণর্বাসন কাজ চলছে। এ প্রকল্পের আওতায় নতুন ভবনে সাব-স্টেশনটির সব সরঞ্জামাদি স্থানান্তর কাজ প্রায় শেষ পর্যাযে। এখানে ২২ এমভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ৩৩/১১ কেভি ট্রান্সফর্মারও স্থাপন করা হয়েছে। ফলে রূপাতলী সাব-স্টেশন থেকে ৫০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এছাড়াও কাশীপুর ও পলাশপুর সাব-স্টেশনগুলোও পুনর্বাসন করা হচ্ছে। এ নগরীর ৪টি ৩৩/১১ কেভি সাব-স্টেশনে সংযুক্ত প্রায় ২৮টি ফিডারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ওজোপাডিকো। নগরীর কিছু কিছু বিতরন ও সরবরাহ লাইনও পরিবর্তন হচ্ছে। রূপাতলী-কাশীপুর ৩৩ কেভি লাইনটি পুনর্বাসন কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে এসব লাইন ভূগর্ভস্থ ক্যাবলে রূপান্তরের তাগিদ রয়েছে বিশেষজ্ঞ মহলের। নগরীর চাঁদমারী ও নবগ্রাম রোডে আরো দুটি ৩৩/১১ কেভি সাব-স্টেশন নির্মানের কথা রয়েছে প্রকল্পের আওতায়। কিন্তু জমি অধিগ্রহন প্রক্রিয়ার বিলম্বের কারণে নবগ্রাম রোডের সাব-স্টেশনটির কাজ শুরু করতে আরো অন্তত ছয় মাস অপেক্ষা করতে হতে পারে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ১১/.০৪ কেভি ট্রান্সফর্মারও পরিবর্তন করা হচ্ছে। তবে তা পুরনো ট্রান্সফমার পুড়ে যাবার পরে। প্রায় সব ১১ কেভি ট্রান্সফর্মারই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এমসিপি সহ ড্রপ আউটের অভাবে। এখনো এ নগরীর একটি ট্রান্সফর্মারের ফিউজ পুড়ে গেলে পুরো ফিডারই বন্ধ করতে হয়। ১১ কেভি লাইনগুলোতে ইতোপূর্বে কিছু আইসোলেটর স্থাপন করা হলেও তার বেশীরভাগই অকার্যকর। ৩৩ কেভি লাইনগুলোর ইনস্যুলেটর ও পিনগুলো দীর্ঘদিনের পুরনো। ১০ কিলোমিটার বেগে বাতাস ছাড়লেও বরিশাল মহানগরীর ৩৩ কেভি লাইনগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ নগরী সহ দক্ষিণাঞ্চলের বেশীরভাগ জেলা ও উপজেলার সদরের বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বিতরন ব্যবস্থা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষন করা হচ্ছেনা। অবশ্য এজন্য ব্যাপক জনবল সংকটের কথাও জানিয়েছেন ওজোপাডিকো’র দায়িত্বশীল মহল।
এসব পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পাশাপাশি বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা দুর্নীতি ও হয়রানিমুক্ত করারও দাবী রয়েছে সাধারন মানুষের। নতুন সংযোগ গ্রহন থেকে পুরনো সংযোগগুলোর মিটার পরিবর্তনে একজন গ্রাহককে যথেষ্ট দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, দালাল না ধড়লে ওজোপাডিকো’র নতুন সংযোগ পাওয়া কঠিন। এমনকি ডিজিটাল মিটার স্থাপনের পরে ছয়মাস থেকে বছরের মাথায় এসব মিটার বিকল হয়ে যাচ্ছে। আর ঐসব মিটার পরিবর্তনে গ্রাহককে নিজের টাকায় নতুন মিটার সংগ্রহ করার পাশাপাশি এখন সে জন্য প্রায় সাড়ে ৩শ টাকা জমাও দিতে হচ্ছে। আর এ পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতেও অনেক ক্ষেত্রে দালাল ধরতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
অপরদিকে বরিশাল মহানগরী সহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ইন্টারনেট-এর ব্রডব্যান্ড লাইন সহ ক্যাবল টিভির লাইনগুলোতে যে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হচ্ছে, তার প্রায় পুরোটাই অবৈধভাবে সংযূক্ত। আর এ অবৈধভাবে ব্যবহৃত বিদ্যুতের পুরোটাই চুরি হচ্ছে। এর সাথে মাঠ পর্যায়ের কর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিতরন বিভাগের দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধেও সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে।
তবে এসব বিষয়ে ওজোপাডিকো’র বিভিন্ন বিতরন বিভাগ ও তার তত্ত্বাবধানকারী কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করা হলে তা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু ঐসব ব্রডব্যান্ড লাইন ও ক্যাবল টিভিতে বিদ্যুৎ কোথা থেকে আসছে সে সম্পর্কে কোন কিছু বলতে পারেননি দায়িত্বশীল মহল। পাশাপাশি আসন্ন গ্রীষ্ম ও রমজানে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা যথেষ্ট নির্বিঘœ থাকবে বলেও দাবী করেছেন কর্তৃপক্ষ।