3:37 pm , February 15, 2019

খান রুবেল \ নগরীতে রোগীর দালালদের দৌরাত্ম থামছে না। বরং প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সদর রোড সহ গোটা নগরী। গ্রামগঞ্জ সহ দুর দুরন্ত থেকে আসা অসহায় রোগীদের ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিচ্ছে সর্বস্ব। এতে রোগী ও তাদের স্বাজনরা পথে বসলেও দালালির টাকায় ফুলে ফেপে কলাগাছ হচ্ছে দালাল ও তাদের মদদদাতা চিকিৎসক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকরা। দালাল প্রতিরোধে প্রশাসনের জোড়ালো কোন পদক্ষেপ না থাকায় বিব্রত হচ্ছে নগরীর খ্যাতনামা চিকিৎসকরাও। সরেজমিনে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিভাগীয় শহর বরিশাল নগরীর সদর রোড, হাসপাতাল রোড, বান্দ রোড, প্যারারা রোড ও বগুরা রোড এলাকার নামিদামী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বার। তাছাড়া দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এখানে প্রতিদিন দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ রোগ দেখাতে আসছে নগরীতে। কিন্তু দুই তৃতীয়াংশ রোগীই তাদের পছন্দের চিকিৎসকেরকাছে পৌছতে পারছে না। বাস কিংবা লঞ্চ থেকে নামা মাত্রই তাদের কব্জা করে নগর জুড়ে বিস্তৃত দালাল চক্রের ফাঁদে পড়তে হচ্ছে তাদের। রিকসা, অটো ও মাহেন্দ্র চালক বেশে থাকা দালাল চক্র তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে নামকাওয়াস্তে হাতুড়ে চিকিৎসকদের কাছে। চিকিৎসকের ভিজিট, পরীক্ষা নিরীক্ষার ফি’র নামে তাদের কাছ থেকে রক্ত চোষার মত করে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। কিন্তু হাজার হাজার টাকা খরচ করে দালাল নির্ভর হাতুড়ে ডাক্তারদের কাছ থেকে যে চিকিৎসা তারা পাচ্ছে তাতে রোগী রোগ মুক্ত হচ্ছে না। বরং ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আরো আক্রান্ত হচ্ছে তারা।
সরেজমিনে দেখাগেছে, শুধুমাত্র নগরীর সদর রোড এলাকাতেই প্রতিদিন রোগী ধরার ফাঁদ পেতে বসছে প্রায় অর্ধশত দালাল। যারা সবাই ফজলুল হক এভিনিউ, আগরপুর রোড, সদর রোড, প্যারারা রোড, হাসপাতাল ও বগুরা রোডের কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাতুড়ি চিকিৎসকের হয়ে রোগী ধরার কাজ করছে। দালাল নির্ভর হাতুড়ে চিকিৎসকদের তালিকায় রয়েছেন সিএন্ডবি রোডের ডা. এম সাইফুল ইসলাম, ডা. হরিহর রায় চৌধুরী, ডা. হাসানুজ্জামান, ডা. মো. মোস্তফা, ডা. অমিতাভ কুমার ও ডা. কামরুন্নাহার সহ প্রায় ডজন দুই চিকিৎসক। যারা সাইন বোর্ডের নিজেদের নামের আগে বিভিন্ন ভুয়া পদ পদবী ব্যবহার করছে।
এদিকে চিকিৎসকের হয়ে সদর রোড এলাকায় দালালী করছে প্রায় অর্ধশত দালাল। যারা যুগ যুগ ধরে দালালী করে রোগীর অর্থ লুটে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে। এসব দালালদের তালিকায় রয়েছে বাটার গলির স্বপন, তার চার শ্যালক সুমন, মামুন, ইমন ও সাদ্দাম। এছাড়াও রয়েছে নাসির, সাদ্দাম, বাদল, মিজান, রফিক, তালই, সোলায়মান, খোকন, মাসুম, সাহাবুদ্দিন ওরফে সাবু, জয়নাল, দুলাল, মজিবর ও খোকন ওরফে কানা খোকন সহ আরো অনেকে।
সদর রোডের বিবির পুকুর পাড়ে হাবিব ভবনের সামনে, বাটার গলি, বেলভিউ’র সামনে, সাবেক দক্ষিণাঞ্চল গলি, আগরপুর রোডে দী মুন মেডিকেল সার্ভিসের সামনে দালাল চক্রের অবস্থান। বিশেষ করে ফললু হক এভিনিউ সড়ক থেকে হাসপাতাল রোড পর্যন্ত বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বার ও প্রতিষ্ঠিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালের সামনে দালালরা ঘাটি গেড়ে ফাঁদ পেতে বসছে।
সূত্র জানিয়েছে, দালালরা রোগী ঠকানোর অর্থে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। বিশেষ করে দালাল সর্দার স্বপন দালালীর টাকায় বেশ ধন সম্পদের মালিক হয়েছে। তিনি বাটার গলিতে একটি ভবনের তৃতীয় তলায় থাকেন। তার ঘরে ব্যবহার হচ্ছে দুটি এসি। ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার ডিবির হাতে আটক হয় স্বপন। কাউনিয়ার বাসিন্দা দালাল মিজান দালালীর টাকায় নির্মান করেছে দুই তলা বিল্ডিং। তালই নামের পরিচিত ব্যক্তিও কাউনিয়া এলাকায় দ্বিতল বাড়ি করেছে। তাছাড়া দালালির অর্থে ছেলেকে লেখাপড়া করিয়ে বানিয়েছে পুলিশ সদস্য। রূপাতলী হাউজিং এলাকার সাদা চুল নাসিরও দালালির অর্থে ফুলে ফেপে উঠেছে। সদর রোডে পূর্বে ফলের ব্যবসা করা সাবু, রিকসা চালক জয়নাল, দুলালও রিকসা চালকের আড়ালে দালালী করে লাখপতি হয়েছে।
এদিকে সদর রোডের বাইরে নগরীর রূপাতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় দালালের বিশাল সিন্ডিকেট রয়েছে। ১১ সদস্যের এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছে আব্দুর রশিদ ও তার ভাই সহিদ। তাদের সহযোগী হিসেবে রয়েছে কানা লিটন, রুহুল, মোজাম্মেল ও রিপন সহ কয়েকজন। এদের মধ্যে দালাল সরদার রশিদ তার বাহিনী নিয়ে অবস্থান করে বরিশাল-পটুয়াখালী সড়কের লিলি পাম্পের সামনে। তার ভাই সহিদের অবস্থান বাস টার্মিনালের ঝালকাঠি কাউন্টারের সামনে। এরা বেশিরভাগ সময় রিকসা চালক ও অটো চালকবেসে রোগীদের ফাঁদে ফেলে থাকে।
সূত্র জানিয়েছে, দালাল সিন্ডিকেটের সাথে স্ব স্ব এলাকার ক্ষমতাসীন নেতা, জন প্রতিনিধি ও কতিপয় পুলিশের সাথে সখ্যতা রয়েছে। তাদের মাসোহারা দিয়েই দালালী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে দালাল। যে কারনে দালাল চক্র প্রতিরোধে প্রশাসনের জোড়ালো কোন ভুমিকা দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে ডিবি পুলিশ অভিযানের নামে আইওয়াশ করলেও বেশিরভাগ সময় তাদের ভুমিকা নিরব দর্শকের। আবার মাঝে মধ্যে যাদের আটক করা হচ্ছে তাদের আদালতে চালান দেয়া হচ্ছে ছোটখাটো ধারায়। যে কারনে যখন আটক হচ্ছে তার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আদালতে জরিমানা দিয়ে বেরিয়ে আসছে।
স্থানীয়রা বলছেন, দালাল প্রতিরোধে শুধু পুলিশি অভিযানই যথ্যেষ্ঠ নয়। এজন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। দালালদের পাকরাও করে তাদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা দেয়া হলে কিছুটা হলেও এর প্রতিরোধ সম্ভব। পাশাপাশি একবার অভিযান চালিয়ে বসে থাকলে চলবে না, এজন্য প্রতিনিয়ত অভিযোগ দরকার। তবেই দালালদের থেকে অসহায় রোগীরা মুক্তিপাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সচেতন মহল।