2:02 am , January 23, 2019
খান রুবেল ॥ সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মালিকানাধীন প্রায় ৮ একর জমি অবৈধভাবে ইজারা দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোন প্রকার দরপত্র (টেন্ডার প্রক্রিয়া) আহবান না করে ২০১৫ সালে তিন বছরের জন্য ১৬ ব্যক্তির কাছে ওই পরিমান জমি ইজারা দেয়। বিনিময়ে তৎকালিন নির্বাহী প্রকৌশলী ও একজন সার্ভেয়ার মোটা অংকের উৎকোচ গ্রহন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এমন অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছেন বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাঈদ। পানি উন্নয়ন বোর্ড সদর দপ্তর পুরো অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানাগেছে, ২০১৫ সালের জুলাই থেকে প্রায় দুই বছর পাউবো’র রাজস্ব শাখার সার্ভেয়ার হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন কার্যসহকারী শরিফুল ইসলাম শাহিন। একই সময় পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন যান্ত্রিক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজিজুল হক। তারা দু’জন দায়িত্বে থাকাবস্থায় ২০১৫ সালে নভেম্বর মাসে ১৬ জন ব্যক্তিকে বিভিন্ন পরিমানে মোট ৭৯৯.৭৫ শতাংশ জমি অবৈধভাবে ইজারা দেয়। কিন্তু এর রাজস্ব জমা হয়নি সরকারি কোষাগারে। ২০১৬ সালে জমির বিবরণি পাউবো সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। তখন পূর্বের জমির সাথে মিল না থাকায় অনিয়ম ধরা পড়ে। সরেজমিনে দেখা যায়, অবৈধভাবে লিজ দেয়া জমির মধ্যে নগরীর পানি উন্নয়ন বোর্ড সাগরদী কার্যালয়ের পশ্চিম পাশে জেলা পরিষদ কর্তৃক অধিগ্রহনকৃত ১.৭৫ শতাক জমির ইজারা গ্রহন করেন নির্মলেন্দু রায় বাবু নামের জনৈক ব্যবসায়ী। পূর্ব পাশে পাউবো’র সিমানা প্রাচীর ঘেষে ০.০৫ শতক জমির ইয়াজারা দেয়া হয়েছে ইউসুফ আলী মিলন নামের একজন সরকারি কর্মচারীকে। দুটি জমিতেই অবৈধভাবে বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মান করা হয়েছে। এর মধ্যে ১.৭৫ শতক জমির উপর দ্বিতল ভবন এবং অপর ০.০৫ শতক জমিতে এক তলা টিন সেট ভবনে মার্কেট নির্মান করেছেন অবৈধভাবে লিজ গ্রহিতাদ্বয়। দুটি জমিতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ভবন ও স্থাপনা অপসারনের জন্য জেলা পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট লিজ দাতাদের একাধিকবার নোটিশ দেয়া হয়। পাশাপাশি এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য তৎকালিন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজিজুল হককে নির্দেশনা প্রদান করেন পাউবো’র পওর সার্কেলের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রমজান আলী প্রামানিক। কিন্তু তার নির্দেশনার গুরুত্ব দেননি নির্বাহী প্রকৌশলী আজিজুল হক। এসব কারনে আজিজুল হককে নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি সার্ভেয়ারের পদ থেকে অব্যহতি দেয়া হয় কার্য সহকারী শরিফুল ইসলাম শাহিনকে। তার আগে দুর্নীতির প্রাথমিক অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৫ সালের ৩০ জুন বরিশাল পাউবো’র অধিনে থাকা সকল জমি’র নতুন লিজ প্রদান ও পূর্বের লিজ গ্রহিতাদের নবায়ন কার্যক্রম বন্দের নির্দেশ দেয় পাউবো সদর দপ্তর।
এদিকে নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব পাওয়া মো. বাবুল আখতার পাউবো’র ইজারা চুক্তি ভঙ্গ করে ভবন ও বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় ইজারা বাতিলের নোটিশ জরি করেন। কিন্তু পরবর্তীতে রহস্যজনক কারনে ১৬ জন ইজারাদাতাই তাদের দখল কার্যক্রমে বহাল থাকে। তাছাড়া ২০১৮ সালের নভেম্বরে তাদের ইজারা মেয়াদ শেষ হলেও এখনো সবাই বহাল রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি দায়িত্বশিল সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে আসলে বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালিন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজিজুল হক ও সার্ভেয়ার শরিফুল ইসলাম শাহিনকে শোকজ করে। পাশাপাশি ২০১৭ সালে তাদের কাছে ৭৯৯.৭৫ শতাংশ ইজারাকৃত জমির রাজস্ব আদায়ের তথ্য দাখিলের নির্দেশ দেন বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাঈদ। কিন্তু তা দিতে ব্যর্থ হন সাবেক সার্ভেয়ার শরিফুল ইসলাম শাহিন।
অপরদিকে সরকারি জমি অবৈধভাবে লিজ প্রদানের বিষয়ে ঢাকা ও স্থানীয় পর্যায়ে তিন দফায় তদন্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালে গঠিত একটি তদন্ত কমিটি দু’জনকে শোকজ করে। এদের মধ্যে সার্ভেয়ার শরিফুল ইসলাম শাহিন ২০১৭ সালের ১৪ এপ্রিল আত্মপক্ষ সমর্পন করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের শৃঙ্খলা পরিদপ্তরের পরিচালক বরাবর আবেদন করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন ২০১২ সালে ১০ জানুয়ারী টেন্ডার কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে ১৬ জন ব্যক্তিকে ৭৯৯.৭৫ শতাংশ জমি ইজারা দেয়া হয়। ২০১৫ সালে ইজারা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের বিষয়টি ভুলবসত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। সেই সাথে ইজারার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র জানায়, অবৈধভাবে ইজারা গ্রহনের বিষয়টি ধামা চাপা দিতেই ২০১২ সাল টেনে আনা হয়েছে। তাছাড়া যে ১৬ জনকে ইজারা প্রদান করা হয়েছে পাউবো’র রেজিষ্ট্রার অনুযায়ী ৪ জন লিজ গ্রহিতা এখনো ইজারা’র জামানাতের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। এরা হলেন বাকেরগঞ্জের বামনীকাঠির মো. জসিম উদ্দিন, হিজলা উপজেলার মোল্লা’র হাটের হযরত আলী বেপারী, মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার প্রদীপ কুমার ও একই উপজেলার অরুন চন্দ্র কর। অথচ ২০১২ সালের যে বিবরণি দাখিল করা হয়েছে তাতে ওই চারজনের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবু সাঈদ বলেন, এসব ঘটনা আমার দায়িত্বকালিন সময় ঘটেনি। তবে পুরো অভিযোগের বিষয়টি এখনো তদন্ত হচ্ছে। ২০১৮ সালের শেষ দিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড সদর দপ্তরে এ সংক্রান্ত একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। এরই মধ্যে তারা বরিশালে এসে সরেজমিনে তদন্ত করেছেন। পূনরায় তাদের বরিশালে তদন্তে আসার কথা রয়েছে।