2:01 am , January 23, 2019

সাঈদ পান্থ ॥ পরিবেশ বান্ধব নগরী হবে প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত ধান-নদী-খালের শহর বরিশাল। এই নগরীর জালের মত বিস্তৃত খাল ও পুকুরগুলো এখন মরা জলাশয়ে পরিনত হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে পানি প্রবাহ। বর্ষায় ডুবে যায় এই নগরীটি। এসব বিষয় মাথায় রেখে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহন করেছে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। নগরীর ৪৬ খাল ও ৩০ পুকুর নিয়ে উন্নয়ন যজ্ঞ শুরু করতে ইতিমধ্যে প্রায় ১৪শ’ কোটি টাকার প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছে সিটি কর্পোরেশন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে খালগুলো দখল মুক্ত, খনন ও পুনঃ খনন করা হবে। এছাড়াও সরকারি পুকুর উদ্ধার করা হবে এই প্রকল্পের মাধ্যমে। আর এই প্রকল্প যদি বাস্তবায়িত হয় তবে বরিশাল ফিরে পাবে তার হারানো ঐতিহ্য। বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশলী বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল নগরীর ৪৬টি খাল ও ৩০টি সরকারি পুকুর নিয়ে ১ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ে প্রেরন করেছে বিসিসি। প্রকল্পের নাম ‘বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন খাল সমূহের পার সংরক্ষণ সহ পুন:রুদ্ধার ও পুন:খনন’। সাড়ে ৩ বছর মেয়াদী এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৪৬ টি খাল পুন: খননের জন্য বরাদ্ধ ধার্য করা হয়েছে ১২১ কোটি টাকা। ১০৯ কিলোমিটার এলাকার খালগুলোর দুই পাড়ের ২৩ কিলোমিটার স্থানে করা হবে সৌন্দর্য বৃদ্ধি। এ জন্য বরাদ্ধ ধরা হয়েছে ৪৮০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ঘাটলা, বসার বেঞ্চ, ড্রেন, লাইট, ১৭টি আরসিসি ব্রিজ ও ৩০টি পুকুর সংস্কারের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৮৭ কোটি টাকা। খালগুলোর মধ্যে অন্যতম নগরীর ১, ২, ৭, ৮, ৯, ১৯ ও ২০ নং ওয়ার্ডের জেল খাল। যা কীর্তনখোলা নদীর তীর থেকে নতুল্লাবাদ পযর্ন্ত বিস্তৃত। ১২, ১৪, ২৩, ২৪ ও ২৫ নং ওয়ার্ডের সাগরদী খাল। যা কীর্তনখোলা নদীর তীর থেকে চৌমাথার ব্রিজ পর্যন্ত বিস্তৃত। নগরীর ১, ৩ ও ২৯ নং ওয়ার্ডের লাখুটিয়া খাল। যা মরকখোলা পোল থেকে আবেদ আলী শাহ মাজার পর্যন্ত বিস্তৃৃত। নগরীর ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের আমানতগঞ্জ খাল। যা কীর্তনখোলা নদীর তীর থেকে মহাবাজ পযর্ন্ত বিস্তৃত। নগরীর ১২, ১৩ ও ১৪ নং ওয়ার্ডের নাপিতখালী খাল। যা মেডিকেলের পিছনের বাউন্ডারী থেকে সাগরদীখাল পযর্ন্ত বিস্তৃত। কীর্তনখোলা নদী হতে সার্কেট হাউসের পাশ দিয়ে সদর রোড-বিবির পুকুর পযর্ন্ত বিস্তৃত ১০, ১৬ নং ওয়ার্ডের ভাটার খাল। ১৬, ২৬ ও ২৭ নং ওয়ার্ডের ভাড়ানী খাল। কীর্তনখোলা নদীর তীর থেকে ব্যাপ্টিস্ট মিশন রোড পর্যন্ত বিস্তৃত ৯, ২৩, ২৫ ও ২৬ নং ওয়ার্ডের চাঁদমারী খাল। বরিশাল বানারীপাড়া রোড হতে কুদঘাটা পর্যন্ত ২৭ নং ওয়ার্ডের ভেদুরিয়া খাল। ২৯ ও ৩০ নং ওয়ার্ডে ইছাকাঠী উত্তর কড়াঁপুর রাস্তা সংলগ্ন খাল। সিএন্ডবি রোড থেকে ভেদুরিয়া খাল পযর্ন্ত ৩০ নং ওর্য়াডের কলাডেমা খাল। চৌমাথা থেকে ভাংগার পোল পযর্ন্ত ২২, ২৩ ও ২৭ নং ওয়ার্ডের নবগ্রাম খাল। সোনা মিয়ার পোল থেকে কালিজিরা নদী পযর্ন্ত ২৬ নং ওয়ার্ডের হরিনাফুলিয়া খাল। ৯, ২৩, ২৫ ও ২৬ নং ওয়ার্ডের পুডিয়া খাল। পুরানপাড়া রাস্তা থেকে মহাবাজ পযর্ন্ত ৩ ও ৪ নং ওয়ার্ডের সাপানিয়া খাল। শেরে বাংলা সড়ক থেকে ঠাকুর বাড়ী পর্যন্ত ৪ নং ওয়ার্ডের জাগুয়া খাল। নতুল্লাবাদ ব্রীজ থেকে নবগ্রাম পযর্ন্ত উত্তর নবগ্রাম সাগরদী খাল। কাশিপুর স্কুল থেকে ভেদুরিয়া খাল পর্যন্ত কাশিপুর খাল। ঠাকুরবাড়ী থেকে দরগাহ বাড়ী পর্যন্ত টিয়াখালী খাল। নতুন হাট থেকে বিশ্বাস বাড়ী পর্যন্ত ঝোড়াখালি খাল। ভেদুরিয়া খাল থেকে ডেইরি ফার্ম পযর্ন্ত সোলনা খালসহ ৪৬টি খাল।
সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) মো: হুমায়ুন কবির বলেন, ‘পরিবেশ বান্ধব একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। এই প্রকল্প পাঠানের জন্য আমাদের খালগুলোর সীমানা ম্যাপ অনুযায়ী প্রি-ওয়ার্ক সার্ভে করতে হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ডিজাইন প্রননয় করতে হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বরিশাল পরিবেশ বান্ধব নগরীতে পরিনত হবে। পাশাপাশি পর্যটন ও নৌ পরিবহনে গুরুত্ব বাড়বে। রোধ হবে নগরীর জলাবদ্ধতা।’ যদিও বরিশালের ২৩ মরা খাল দখল মুক্ত, দূষণমুক্ত ও উদ্ধারে তৎপরতা চালিয়ে ছিল জেলা প্রশাসন। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, নৌ পথ ব্যবহারের মাধ্যমে সড়ক পথের চাপ কমানোর পাশাপাশি নগরীর জলাবদ্ধতা দুর করতে এই কাজ করা হয়েছিল। জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআইডব্লিউটিএ, এলজিইডিসহ বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নির্ধারন করা হয় খালগুলো সীমানা। পরে খাল পুনঃ উদ্ধার ও সংস্কার করে হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে প্রায় ২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাঠানো হয় মন্ত্রনালয়ে। এর আগে শুধুমাত্র বরিশালের ঐতিহ্যবাহী জেল খালকে নিয়েও প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু এই দুইটি প্রকল্প অনুমোদন পায়নি। অবশেষে ৪৬টি খাল ও ৩০টি পুকুর নিয়ে এই প্রকল্প পাঠানো হল। বরিশালের নদী-খাল রক্ষার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে বরিশাল নদী-খাল রক্ষা কমিটি। এ সংগঠনের সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিপলু বলেন, ‘এক সময় বরিশালের পরিচিতি ছিল নদী-খালের শহর হিসাবে। অব্যবস্থানা ও নজরদারীর অভাবে দখল ও দুষণে নগরীর ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া খালগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। পূর্বে এই খালগুলো উদ্ধারে দুইটি প্রকল্প করা হয়েছিল। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখেনি। আশা করছি এবারের প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখবে ও বরিশালের উন্নয়ন ঘটবে।’ এ ব্যাপারে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনিসুজ্জামান বলেন, ‘এই প্রকল্পের পূর্বেও দুইটি প্রকল্প পাঠানো হয়েছিল। পরে মন্ত্রনালয়ের নির্দেশনায় আমার বড় আকারে এই প্রকল্প প্রস্তুত করেছি। প্রকল্পটি আমার মাধ্যমে মন্ত্রনালয়ে যাচ্ছে। এই প্রকল্পটি বাস্তাবায়ন হলে পর্যটন সেক্টর, নৌ পরিবহন খাত, নগরী সবুজায়ন হবে এবং জলাবদ্ধতা হ্রাস পাবে। সর্বোপরি একটি পরিবেশ বান্ধব নগরীতে পরিনত হবে এই সিটি।’