6:39 pm , May 22, 2018

মর্তুজা জুয়েল ॥ যে হাতে রান্না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তৃপ্ত হতো, এখন সেই হাতের ছোয়ায় তৈরি খাবারে তৃপ্তি পাচ্ছে নগরবাসী। গত ৪৬ বছর ধরে নগরীর ভোজনরসিকদের রসনা তৃপ্ত করে চলা এই ব্যক্তি হলেন বগুড়া রোডের পেসকার বাড়ীর বাসিন্দা মো. নাজেম আলী। তার নিপুন হাতের ছোয়ায় ও নির্দেশনায় তৈরী নানা রকমের খাবার খেতে নগরবাসীরা ভীড় করে তার নিজ নামে প্রতিষ্ঠিত নাজেমস’ রেস্তোরাঁয়। তার তৈরি বিরিয়ানী ও ফিরনী নগরীতে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। যেকোন আয়োজনের পূর্ণতা পেতে খাবারের শেষে এই ফিরনীর জুড়ি মেলা ভার। একইভাবে রমজানকে ঘিরে তার ইফতারীর নানা আয়োজনও সাড়া ফেলেছে। তাই ইফতারির পূর্বে বগুড়া রোডে নাজেম’স রেস্তোরাঁর সামনে থাকে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভীড়। তৈরি খাবার শুধু স্বাদে অনন্য নয়, একই সাথে রুচিশীল ও স্বাস্থ্যসম্মত।
রান্নার শিল্পী হয়ে উঠা শুরু দেশ স্বাধীনের যুদ্ধে। সেই সম্পর্কে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে নবম সেক্টরের বেসামরিক প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম মঞ্জুর নেতৃত্বে একটি দল নৌ-পথে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সেই যোদ্ধাদের বহরে ছিলেন নাজেম আলী। সহযোদ্ধাদের জন্য একটি হরিন শিকার করেন নুরুল ইসলাম মঞ্জু। নৌযানে শিকার করা হরিন রান্না নিয়ে সকলেই শংকিত হয়। সকলের শংকা দূর করেন নাজেম আলী। সকলকে অবাক করে স্বল্প সময়ের মধ্যে হরিন’র মাংস রান্না করে সকলের রসনা তৃপ্ত করেন। নাজেম আলীর রান্না করা হরিন’র মাংসের স্বাদে সকলকে নিজের মোহে আবদ্ধ করেন তিনি। সেই থেকে শুরু। যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার তৈরীর অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজটি করেছেন তিনি। প্রশিক্ষন ও যুদ্ধ করে ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষুধা নিবারন করেছেন দুই হাতের তৈরি সুস্বাদু খাবার দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিরুপ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে তার তৈরি খাবারে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের রসদ এনে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার ব্যাবস্থা করার দায়িত্ব ছিলো তার। অক্লান্ত পরিশ্রম করে শত শত মুক্তিযোদ্ধাকে নিজহাতে একমুঠো খাবার তুলে দেয়ার সেই স্মৃতি তাকে আজো আনন্দ দেয়। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে এসে এখনোও একটুও ক্লান্ত হননি মুক্তিযোদ্ধা নাজেম আলী। বর্তমানে তার ইফতারী আয়োজনে দেশী ও শাহী খাবারের প্রায় ৩০টি আইটেম রয়েছে। এর মধ্যে নাজেম’স এর স্পেশাল ফিরনী ও শাহী জর্দ্দার চাহিদা সবচেয়ে বেশী। সাশ্রয়ী মূল্য ও স্বাদে অনন্য হওয়ায় অনেক দূর থেকেও ক্রেতারা এখানে আসছেন। রেস্তোরার প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব নাজেম আলীর ঐতিহ্যবাহী মোরগ-পোলাও, তেহেরী, কাচ্চি বিরিয়ানি ও হালিমের বিশেষ কদর রয়েছে ক্রেতাদের কাছে। এখানের তৈরী মাংসের মধ্যে মুরগীর মোসাল্লেম এবং খাসির রানের সাথে ফ্রি পরাটা এবং গরুর কালোভূনা খাবারে ভিন্ন স্বাদের মাত্রা যোগ করে বলে জানান ক্রেতারা।
এখানে ইফতারি নিতে আসা কলেজ শিক্ষক আব্দুল লতিফ জানান, প্রতিবছরই এখানে ইফতার সামগ্রী কিনতে আসি। নাজেমস এর ইফতার সামগ্রী প্রতিদিনই ইফতারের পূর্বেই শেষ হয়ে যায়, ফলে এখানে বাসী খাবারের কোন ভয় নেই। এছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ থাকায় এখানের খাবার স্বাস্থ্য সম্মত, মূল্যও তুলনামূলক কম।
নাজেম আলীর পুত্র ও নাজেম’স রেস্তোরার পরিচালক ফরিদুর রহমান রেজা জানান, নাজেম’স এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ব্যতিক্রম আইটেম ও স্বল্পমূল্য। সকল শ্রেনী পেশার রোজাদারদের মানসম্পন্ন ইফতারি সরবরাহের কথা মাথায় রেখে আমারা প্রতিটি আইটেম সর্বনি¤œ মূল্যে সরবরাহ করার চেষ্টা করছি। এর মধ্যে ফিরনি ২৫ টাকা থেকে ২৪০ টাকা, শাহি জর্দ্দা ৫’শ গ্রাম ১০০ টাকা, হালিম ১৬০ টাকা, জিলাপি ১৪০ টাকায় সরবরাহ করছি। মোরগ পোলাও (হাফ) ১৩০ টাকা, তেহেরী (হাফ)১২০ টাকা, কাচ্চি বিরিয়ানি (হাফ) ১৬০ টাকায় সরবরাহ করছি। এছারা চিকেন কাবাব ১০ টাকা, চিকেন পুলি ১০ টাকা, আলু ও বেগুনী পিয়াজু মাত্র ৫ টাকায় সরবরাহ করছি। খাবার তৈরীতে বিশুদ্ধ তেল, উন্নত মানের মশলা ও উপকরন ব্যাবহার করায় আমাদের খাবারের স্বাদ আলাদা। ফলে কোন প্রচারনা ছাড়াই আমাদের এখানে ইফতারের পূর্বেই তৈরীকৃত ইফতারী শেষ হয়ে যায়।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানাগেছে মুক্তিযুদ্ধে নাজেম আলির ত্যাগের কথা জানেনা অনেকেই। সকলেই তাকে বরিশালের বিখ্যাত নাজেমস রেস্তোরাঁর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই চেনে। তবে যুদ্ধের সময় তিনি যেভাবে নিজের হাতকে অস্ত্রের মত ব্যবহার করেছেন তা এখনোও সচল রয়েছে।