3:46 pm , November 6, 2018

খান রুবেল ॥ সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের সাপানিয়া গ্রামের বাগান থেকে তৃতীয় শ্রেনী পড়–য়া শিশু কন্যার লাশ উদ্ধার করেছে মা। রহস্যজনক কারনে হত্যার শিকার শিশু কন্যা সাবিহা আক্তার অথৈ (৯) সাপানিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও সিটি কর্পোরেশনের পাম্প অপারেটর কাজী গোলাম মোস্তফার কন্যা। অথৈ সাপানিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেনীর ছাত্রী ছিল। শিশু কন্যা অথৈ হত্যাকারী হিসেবে পুলিশ ও এলাকাবাসীর সন্দেহের তীর বাবা মোস্তফার দিকে। তাই পুলিশ হেফাজতে রেখে মোস্তফাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এছাড়াও শিশু কন্যার মায়ের সন্দেহের কারনে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাব্বি ওরফে রাবু নামের একজনকে তাদের হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। গতকাল মঙ্গলবার এ ঘটনা ঘটেছে। তবে এলাকাবাসী সুত্রে জানা গেছে, একমাত্র শিশু কন্যা অথৈ ছিল তার বাবার অন্ত.প্রান।
এলাকাবাসী ও পুলিশ জানিয়েছে, কন্যা অথৈকে স্কুল থেকে বাড়ীতে নেয়ার জন্য বেলা প্রায় পৌনে ১১টার দিকে ঘর থেকে রওনা হয় মা শিউলী আক্তার রুমা। স্কুল ও বাড়ির মধ্যবর্তি সাপানিয়া গ্রামের ছাদওয়ালা বাড়ী সংলগ্ন এলাকার লেবু বাগানের মধ্যে কন্যাকে পড়ে থাকতে দেখতে পায় মা রুমা। সেখান থেকে মা রুমা অচেতন অথৈকে উদ্ধার করে শেবাচিম হাসপাতালে নেয়। হাসপাতালের জরুরী বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. মাহাবুবুর রহমান শিশু কন্যাকে মৃত ঘোষনা করেন। ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, বেলা সাড়ে ১১টায় শিশুটিকে শেবাচিম হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে আসে স্বজনরা। কিন্তু তার অনেক পূর্বে শিশুটির মৃত্যু হয়েছে। শিশুর গলায় লাল দাগ রয়েছে। তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও তাকে শারিরিক নির্যাতন কিংবা যৌন নিপিড়ন করা হয়েছে কিনা বিষয়টি ময়না তদন্ত প্রতিবেদন না এলে নিশ্চিত হওয়া যাবে না বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। এদিকে, শিশু অথৈ’র বাবা কাজী গোলাম মোস্তফার দাবী করেন, সোমবার রাতে সাপানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মনিরুজ্জামান অথৈ’র মা শিউলী আক্তার রুমাকে ফোন করে উপবৃত্তির জন্য ছবি সহ কন্যাকে স্কুলে নিয়ে যেতে বলে। এমনকি দ্বিতীয় দফায় গতকাল মঙ্গলবার সকালেও ফোন করেন শিক্ষক মনির। তাই সকাল ৯টার দিকে তিনি অফিসে যাবার সময় মোটর সাইকেলেযোগে কন্যাকে স্কুলের গেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে যান।
তিনি দাবী করে বলেন, মেয়ের বাসায় ফিরছে কিনা জানতে স্ত্রী রুমাকে ফোন করেন। কন্যা বাসায় না ফেরায় স্ত্রীকে স্কুলে গিয়ে খোঁজ নিতে বলেন। স্ত্রী রুমা ছাদওয়ালা বাড়ি কাছে লেবু বাগানের কাছাকাছি গেলে সেখান থেকে এক যুবককে যেতে দেখে। এরপর কিছুদুর সামনে আগাতেই লেবু বাগানের মধ্যে মেয়ের লাশ পড়ে থাকতে দেখে তার মা।
গোলাম মোস্তফা বলেন, মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে আমিও বাড়িতে ফিরে আসি। পথিমধ্যে দেখতে পাই বাগানের মধ্যে থেকে মেয়র লাশ উদ্ধার করে ভ্যান গাড়িতে করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখান থেকেই স্থানীয়দের সহযোগিতায় মেয়েকে উদ্ধার করে শেবাচিম হাসপাতালে নিয়ে আসলে চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষনা করেন। তিনি সহ পরিবারের দাবী অথৈকে শ্বাস রোধে হত্যার পরে লেবু বাগানের মধ্যে ফেলে রেখেছে দুর্বৃত্তরা।
তবে কাজী গোলাম মোস্তফা’র দেয়া এমন তথ্যর সাথে বাস্তবে কোন মিল খুজে পায়নি পুলিশ ও এলাকাবাসী। এছাড়াও মোস্তফা শিক্ষক মনিরুজ্জামানের সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়েছে।
এ বিষয়ে শিক্ষক মনিরুজ্জামান বলেন, সোমবার মোস্তফাকে ফোন করা হয়। সে অসুস্থ এবং স্ত্রীসহ হাসপাতালে রয়েছে বলে জানিয়েছে। তাই মোস্তফাকে বলা হয়েছে উপবৃত্তির টাকার সিওর একাউন্টের হিসাব নম্বরে স্ত্রী রুমার স্বাক্ষর প্রয়োজন। স্কুল বৃহস্পতিবার খোলা থাকবে। ওই দিন স্ত্রী রুমাকে স্কুলে আসার জন্য বলা হয়েছে। কন্যা অথৈকে স্কুলে পাঠানোর কথা বলা হয়নি বলে জানিয়েছেন শিক্ষক মনিরুজ্জামান।
বাড়ী থেকে কন্যাকে নিয়ে বের হয়ে যে ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেলে স্কুলে যাওয়ার কথা জানিয়েছে মোস্তফা, সেই মোটর সাইকেলের চালক মো. বাদল পরিবর্তনকে জানায়, কাগাশুরা বাজার থেকে মোস্তফা তাকে ভাড়া করে। পরে বাড়ীর সামনে এসে তাকে অপেক্ষা করতে বলে বাসায় যায় মোস্তফা। পৌনে ৯টার দিকে কন্যাকে নিয়ে বের হয়ে সদর রোড সাউথইষ্ট ব্যাংকের সামনে নামে। তাকে বিদায় দিয়ে কন্যাকে নিয়ে ব্যাংকের পাশের গলিতে চলে যায়। এলাকাবাসী ও পুলিশের নির্ভরযোগ্য সুত্রর ধারনা, কন্যাকে নিয়ে ব্যাংকের গলির পাশের পাম্প হাউজের মোস্তফা তার কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে শ্¦াসরোধ করে হত্যা করে। পরে বোরখা পড়িয়ে একটি সিএনজি ভাড়া করে ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে যায় মোস্তফা। পরে নির্জন লেবু বাগানে কন্যাকে ফেলে রেখে সিএনজি নিয়ে বাড়ীতে যায় মোস্তফা। যা এলাকাবাসী কয়েকজন দেখেছে। পরে সকাল ১০ টা ২৭ মিনিটে রাসেল নামে অপর এক ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেল চালককে ফোন করে মোস্তফা। রাসেল নামে ওই চালক মোস্তফাকে বাড়ীর সামনে থেকে নিয়ে আবার সাউথইষ্ট ব্যাংকের সামনে নামিয়ে দেয়। কিছু সময় পর মোস্তফা ফিরে এসে তাকে নিয়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হয় বলে জানিয়েছে চালক রাসেল।
কিন্তু পুলিশের কাছে মোস্তফার লিখিত দেয়া অনেক তথ্যর গড়মিল ছিল। তা নিয়ে পুলিশ প্রত্যক্ষদর্শীর ব্যক্তিদের নিয়ে মোস্তফার মুখোমুখিও করেছে। তার মিথ্যা তথ্য ও অসংলগ্ন কথা কন্যাকে অথৈ হত্যাকারী হিসেবে বাবা মোস্তফা হিসেবে ধারনা করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত তার স্বীকার না করা এবং হত্যার কোন কারন খুজে না পাওয়া অথৈ হত্যার রহস্য এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত উদঘাটন হয়নি। হত্যার রহস্য উদঘাটন খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে করা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের নির্ভরযোগ্য সুত্র। তাদের ধারনা বাবা মোস্তফার কোন অনৈতিক কিংবা অপকর্ম কন্যা অথৈ দেখেছে বা জেনে ফেলেছে। এই কারনে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
অপর দিকে শিশু কন্যার মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে ঘটনার পর পরই পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তারা হত্যার রহস্য উদঘাটনে যাবতীয় তথ্য ও আলামত সংগ্রহ করেছেন। এ সময় শিশু কন্যার মা রুমার সন্দেহের কারনে ঘটনাস্থলের পাশের বাসিন্দা রাবুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।
কাউনিয়া থানার ওসি মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, খবর পেয়ে আমাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়। প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচ্ছে শিশুটিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। তেমন আলামতও রয়েছে। শিশুর গলায় লাল দাগ দেখা গেছে। মুখ থেকে ফেনা বেরিয়ে ছিলো। তবে উদ্ধারের সময় শিশুটি স্বাভাবিক অবস্থাতেই পাওয়া গেছে। যে কারনে ধর্ষণের কোন বিষয় রয়েছে কিনা সেটি নিশ্চিত নন। ময়না তদন্ত প্রতিবেদন পেলে পুরো বিষয়টি বেড়িয়ে আসবে।
আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রাথমিক তদন্তে আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি তাতে অথৈকে তার বাবা স্কুলে নিয়ে যায়নি। সে তার বাবার সাথেই ছিলো। যে কারনে হত্যাকান্ডের বিষয়টি একটু জটিল মনে হচ্ছে। তাই সন্দেহের বাইরে নেই নিহত অথৈ’র বাবাও। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা ছাড়াও নিহতের মা বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন ওসি।