ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ॥ তবুও হতাশ জেলে-ব্যবসায়ীরা ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ॥ তবুও হতাশ জেলে-ব্যবসায়ীরা - ajkerparibartan.com
ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ॥ তবুও হতাশ জেলে-ব্যবসায়ীরা

6:02 pm , September 25, 2018

রুবেল খান ॥ মৌসুমের শেষ ভাগে নদীতে ধরা পড়তে শুরু করেছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। তবুও হাসি নেই ব্যবসায়ী এবং জেলেদের মুখে। কেননা ইলিশ ধরা পড়ার শুরুর মুহুর্তেই এসে পড়েছে নিষেধাজ্ঞার সময়। প্রজনন মৌসুমের কারনে আগামী ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার। আর এ কারনেই ক্ষতির আশংকা করছে ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবী আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে ইলিশ শিকারের মৌসুম পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন আসেনি নিষেধাজ্ঞার সময়ের। অবশ্য মৎস্য বিভাগের দাবী ভিন্নটা। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যই বৈজ্ঞানিকদের দেয়া সময় অনুযায়ী ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে।
সরেজমিনে নগরীর পোর্ট রোডের অন্যতম বেসরকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহ আগেও সকালটা কর্মব্যস্ত সময় পার করলেও বিকালটাতে অলস সময় কাটাতে হয়েছে পোর্ট রোডের মৎস্য আড়ৎ এর ব্যবসায়ী এবং শ্রমিকদের। কিন্তু গত তিন দিন ধরে হঠাৎ করেই পাল্টে গেছে সেই চিত্র। কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটাতে হচ্ছে তাদের। কেননা গত তিন দিন ধরে পোর্ট রোডের মোকামে ইলিশের আমদানী দ্বিগুনের বেশি বেড়ে গেছে। এগুলো সবই নদীর মোহনা থেকে শিকার হওয়া ইলিশ। গত তিন দিনে এই অবতরণ কেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার মন ইলিশ এসেছে। এমনকি প্রতিদিন ১৮ থেকে ২২টির মত ট্রাকে তা রফতানী হয়েছে রাজধানী সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। হঠাৎ করে নদীর ইলিশ ধরা পড়তে শুরু করলেও হতাশা এবং উৎকন্ঠা কাটছে না জেলে এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে। লাখ লাখ টাকা দাদন দিয়ে ব্যবসা করে আসা মৎস্য আড়ৎদাররা আশংকা করছেন ক্ষতির। এর কারন হিসেবে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে আগামী ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি।
পোর্ট রোডের মৎস্য আড়ৎদার লিয়া মৎস্য আড়ৎ এর সত্ত্বাধিকারী মো. নাসির উদ্দিন মিয়া বলেন, মুলত শ্রাবন, ভাদ্র ও আশ্বিন মাস হলো ইলিশের মৌসুম। বহুকাল ধরেই এই তিন মাসে নদীতে ইলিশ ধরা পড়ে। বিগত কয়েক বছর ধরে সেই প্রেক্ষাপট পাল্টে গেছে। এখন মৌসুমের শুরুতে নয়, শেষ দিকে ইলিশ ধরা পড়ছে। শ্রাবন ও ভাদ্র মাসের পুরোটাই ইলিশ ধরা পড়েনি। সাগরের কিছু মাছ আসলেও নদীতে মাছ ধরা পড়েনি। এখন আশ্বিনে যখন নদীর ইলিশ ধরা পড়তে শুরু করেছে সেই মুহুর্তেই ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে। মৌসুমের পরিবর্তন ঘটলেও ঘটেনি নিষেধাজ্ঞার সময়ের পরিবর্তন।
তিনি বলেন, এতদিন আমরা অলস সময় কাটিয়েছি। তখন নিষেধাজ্ঞা ছিলো না। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার সময় ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে গত তিন দিন ধরে নদীতে ইলিশ ধরা পড়ছে। বিশেষ করে ভোলার চরফ্যাশনে মেঘনা সহ পার্শ্ববর্তী নদীর ইলিশ মোকামে আসতে শুরু করে। গতকাল মঙ্গলবার সারা দিনে আড়াই হাজার মনের মত ইলিশ আমদানী হয়েছে। যা বরিশালের বিভিন্ন বাজারে বিক্রির পরেও ১৮ থেকে ২২টির মত ট্রাক ভর্তি ইলিশ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রফতানী হয়েছে।
ইলিশের আমাদানী বেশি হওয়ায় দামও তুলনামুলক কম ছিলো বলে দাবী করেন লিয়া মৎস্য আড়ৎ এর সত্ত্বাধিকারী মো. নাসির উদ্দিন মিয়া। তিনি জানান, গতকাল ১ কেজি ওজনের প্রতিমন ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার টাকা দরে, ৬ থেকে ৯শ গ্রাম ওজনের এলসি সাইজের প্রতিমন ইলিশ বিক্রি হয়েছে ২৪ থেকে ২৫ হাজার টাকায়। ৪শ থেকে সাড়ে ৫শ গ্রাম ওজনের প্রতি মন ভ্যালকা সাইজের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১৬ হাজার টাকায়। ৩শ থেকে ৪শ গ্রাম ওজনের গোটলা ইলিশ প্রতি মন বিক্রি হয়েছে ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকায়।
এছাড়া গ্রেট সাইজের ইলিশ অর্থাৎ ১২শ গ্রামের মধ্যে প্রতি মন ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৪৫ হাজার এবং দেড় কেজি সাইজের প্রতিমন ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকায়। তবে শুরুর দিকে এলসি সাইজের ইলিশের আমদানী বেশি দেখা গেছে পোর্ট রোডের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে। তাছাড়া যেসব ইলিশ বর্তমানে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে আসছে তার কোনটিই ডিমওয়ালা ইলিশ নয় বলে দাবী ওই মৎস্য ব্যবসায়ীর।
এদিকে পোর্ট রোড মৎস্য আড়ৎদার এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও পোর্ট রোডের ইজারাদার নিরব হোসেন টুটুল বলেন, এতকাল মাছ দেখা যায়নি, তখন নিষেধাজ্ঞাও ছিলো না। এখন মাছ দেখা গেছে, নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হয়েছে। এজন্য ব্যবসায়ীদের সীমাহীন ক্ষতির সম্মুখিন হতে হবে। যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, মৌসুমের শেষ মাস অর্থাৎ আশ্বিনীনে নদীতে ইলিশ ধরা পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু তার মধ্যেই আগামী ৬ অক্টোবর থেকে প্রজনন মৌসুমের কারনে ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে। যা টানা ২২ দিন পর্যন্ত থাকবে। সেই সাথে ইলিশ ধরা পড়ার মৌসুমও শেষ হয়ে যাবে। তাই এই মুহুর্তে যে পরিমান ইলিশ শিকার হচ্ছে তা পরবর্তীতে আর পাওয়া যাবে না। যে কারনে ক্ষতি নিশ্চিৎ।
তিনি অভিযোগ করেন, বর্তমানে যে অভিযান চলছে সে জন্য ইলিশ বাড়ছে না, বরং কমছে। নিষেধাজ্ঞার পূর্বে আমরা যে পরিমান ইলিশ পেতাম তার অর্ধেকও এখন আর পাচ্ছি না। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে বাংলাদেশে ইলিশ শিকার বন্ধ থাকলেও অন্য দেশের জেলেরা তা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাই ইলিশের আমদানীও কমে যাচ্ছে দাবী করে ওই মৎস্য আড়ৎদার এ্যাসেসিয়েশনের নেতা বলেন, গত কদিন ধরেই নদীতে ইলিশ পড়তে শুরু করেছে। মঙ্গলবার পোর্ট রোডের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ২ হাজার মন ইলিশ আমদানী হয়েছে। যার সবই নদীর ইলিশ। তাছাড়া সোমবার ইলিশের আমদানী ছিলো দেড় হাজার মন এবং তার আগের দিন অর্থাৎ ২৩ সেপ্টেম্বর সর্বচ্চ আড়াই হাজার মন ইলিশ আমদানী হয়েছিলো। অথচ গেলো বছরেও এই সময়ে ইলিশের আমদানী ছিলো প্রায় পাঁচ হাজার মনের মত। ইলিশের আমদানী বৃদ্ধির জন্য পুনরায় গবেষনা করে ইলিশের প্রকৃত প্রজননের সময় খুঁজে বের করা এবং নিষেধাজ্ঞার সময় পরিবর্তন করা জরুরী বলে মনে করেন এই মৎস্য ব্যবসায়ী নেতা।
অবশ্য বরিশাল জেলার মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস মৎস্য ব্যবসায়ীদের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, শুধুমাত্র বরিশালের প্রেক্ষাপট হিসেব করলেই হবে না। পুরো দেশের হিসাব করতে হবে। কেননা ২০০৮ সাল থেকে সরকারের ইলিশ সংরক্ষন পদ্ধতি এবং নিষেধাজ্ঞার কারনে সাগর ও নদ নদীতে ইলিশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন বড় বড় সাইজের ইলিশও পাওয়া যাচ্ছে। বরিশাল মৎস্য আড়ৎএ ইলিশ কমে যাবার পেছনে অন্য কারন রয়েছে। ইতিপূর্বে দক্ষিণাঞ্চল থেকে দেশের অন্যান্য জেলা উপজেলাগুলোতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিলো না। তাই ভোলা, কলাপাড়া, মহিপুর সহ অন্যান্য অঞ্চলের মাছও বরিশাল পোর্ট রোডে নিয়ে আসা হতো। পরবর্তীতে এখান থেকে সেগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে রফতানী করা হত। কিন্তু এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতী হয়েছে। তাই বরিশালে না এসে মাছগুলো সরাসরি নির্দিষ্ট স্থানে প্রেরন করা হচ্ছে। এ কারনেই বরিশালের আড়ৎএ মাছের আমদানী কমে গেছে।
তিনি বলেন, মা ইলিশের প্রজনন জো ৪টি। অর্থাৎ আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে মা ইলিশগুলো ডিম ছেড়ে থাকে। কিন্তু তার পরেও আমরা দুইটি মাত্র জোতে এই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকি। বাকি দুটি জো’র মধ্যে জেলেদের ইলিশ শিকারের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এতে করে এক জোতে ব্যর্থ হলে অন্য জো’তে তো তারা ইলিশ ধরতে পারছে। এক্ষেত্রে কোন বাঁধা আসছে না।
মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, চলতি মৌসুমে একটু দেরীতে নদীতে ইলিশ ধরা পড়েছে। তবে এখন যা ধরা পড়ছে তার সবই এলসি সাইজের ইলিশ। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে এই ইলিশগুলো বড় হবে। যা ধরা পড়বে নিষেধাজ্ঞা শেষে। সুতরাং হতাশ হওয়ার কোন কারন নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT