6:17 pm , September 13, 2018
রুবেল খান ॥ নগরীর বিনোদন ও ভ্রমনের স্থান গুলোতে ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের অবাধ ঘোরাফেরার চিত্র উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। ক্লাশে না গিয়ে ওইসব স্পটে শিক্ষার্থীরা আড্ডায় মগ্ন হচ্ছে। এমনকি প্রকাশ্যেই তারা জড়িয়ে পড়ছে আপত্তিকর ঘটনায়। যা দেখে উদ্বিগ্ন হচ্ছে সাধারন মানুষ। পাশাপাশি বৃদ্ধি পাচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়। অবশ্য এমন পরিস্থিতির জন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবক, শিক্ষক এবং আকাশ সংস্কৃতিকে দায়ি করছেন বিশেষ মহল। এমনকি প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। তবে বর্তমান চিত্র পাল্টে দিতে ক্লাশ চলাকালে বিনোদন ও ভ্রমনের স্থান গুলোতে মনিটরিং ও মোবাইল কোর্ট ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান।
সরেজমিনে দেখাগেছে, সম্প্রতি সময়ে নগরীর প্রতিটি বিনোদন ও ভ্রমনের স্থান গুলোতে ক্লাশ চলাকালিন সময়ে শিক্ষার্থীদের অবাধ ঘোরা ফেরা এবং মেলামেশার চিত্র উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্কুল বা কলেজের ইউনিফর্ম পড়েই নির্জন স্থানে বসে গল্পগুজব এবংআড্ডায় মগ্ন হচ্ছে। কোন কোন সময় চোখে পড়ে যায় বিনোদন কেন্দ্র গুলোতে ইউনিফর্ম পড়া শিক্ষার্থীদের অবৈধ এবং আপত্তিকর মেলামেশার চিত্রও।
বিশেষ করে নগরীর বঙ্গবন্ধু উদ্যান, ডিসি লেক, মুক্তিযোদ্ধা পার্ক, প্লানেট পার্ক, বদ্ধভূমি সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীর তীড়ে, আমতলার মোড়ে বিজয় বিহঙ্গে এমন চিত্র যেন পিছু ছাড়ছে না। তবে এর মধ্যে আবার নগরীর প্লানেট পার্ক, বঙ্গবন্ধু উদ্যান ও মুক্তিযোদ্ধা পার্কে ক্লাস চলাকালিন সময়ে শিক্ষার্থীদের অবাধ এবং আপত্তিকর মেলামেশার চিত্র যেন নিত্য দিনের রুটিন ও নিয়মে পরিনত হয়েছে।
নগরীর বঙ্গবন্ধু উদ্যান সংলগ্নে অবস্থিত বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ। এর আশপাশ ঘিরে রয়েছে সরকারি জিলা স্কুল, উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। যার ফলে ওইসব স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিই বেশি দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে। তাছাড়া ইউনিফর্ম পড়া অবস্থায় দেখা মিলছে সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রীদেরও। ক্যাম্পাসের পাশেই মডেল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে ঘোরা ফেরা এবং আড্ডায় মগ্ন হলেও সেদিক দৃষ্টি কাড়ছে না বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর বান্দ রোডে প্লানেট পার্ক এবং মেরিন একাডেমি সংলগ্ন কীর্তনখোলা তীড়ের মুক্তিযোদ্ধা পার্কে ক্লাশ চলাকালে ইউনিফর্ম পড়া শিক্ষার্থীদের অবাধ মেলামেশার চিত্র মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। প্লানেট পার্কের চিত্র এতটাই ভয়াবহ যে তাদের উৎপাতে পরিবার পরিজন নিয়ে কেউ ঘুরতে আসাটাও এখন লজ্জা ও বিচলিত হতে হচ্ছে। কিন্তু পার্ক কর্তৃপক্ষ তাদের বাধা দিচ্ছে না। বরং লোভে পড়ে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের ইউনিফর্ম পড়া অবস্থাতেই পার্কে প্রবেশ এমনকি আপত্তিকর মেলামেশার সুযোগ করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বরিশাল জেলা প্রশাসনের কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, বছর খানেক পূর্বে বিনোদন এবং ভ্রমন কেন্দ্রগুলোতে স্কুল-কলেজ চলাকালে ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে শিক্ষার্থীদের এমন অবাধ মেলামেশা চরম আকার ধরন করেছিলো। তখন জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ প্লানেট পার্ক সহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে বিষয়টি তদারকির জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন। প্লানেট পার্কে স্কুল চলাকালে ইউনিফর্ম পড়া কোন শিক্ষার্থীকে প্রবেশ করতে না দেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। এমনকি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে জেলা প্রশাসন কর্তৃপক্ষ মোবাইল কোর্টের ব্যবস্থাও করে। যে কারনে তখনকার সময় পরিস্থিতি কিছুদিনের জন্য স্বাভাবিক থাকলেও বর্তমানে তা পূর্বের অবস্থানে ফিরেছে।
অবশ্য গত দু’দিন পূর্বে বরিশাল জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান এর উদ্যোগে পূর্বের সেই পদক্ষেপ নতুন করে নিতে দেখা গেছে। ওই সময় বঙ্গবন্ধু উদ্যান এবং ডিসি লেক এলাকা থেকে তোফাজ্জেল হোসেন মানিক মিয়া মহিলা কলেজের চার ছাত্রীকে ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দেয়ার অভিযোগে আটক করা হয়। এমনকি আপত্তিকর মেলামেশার সময় নগরীর একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ও অপর এক যুবককে আটক করা হয়। ওই যুবককে ১৫ দিনের করাদন্ড দেয়া হলেও বাকি ছাত্রীদের তাদের অভিভাবক ও কলেজ কর্তৃপক্ষকে ডেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তবে এর পরেও বঙ্গবন্ধু উদ্যান কিংবা বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে স্কুল চলাকালিন সময়ে ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে শিক্ষার্থীদের উৎপাত বাড়ছে ছাড়া কমছে না।
গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে ক্লাশ চলাকালিন সময় নগরীর বঙ্গবন্ধু উদ্যানে দেখা যায় পূর্বের সেই একই চিত্র। মডেল স্কুল এন্ড কলেজ ও উদয়ন স্কুলের কতিপয় শিক্ষার্থী প্রকাশেই ঘোরা ফেরা করছে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে। বঙ্গবন্ধু উদ্যানে দুই স্কুলের শিক্ষার্থীদের অবাধ মেলামেশার চিত্র কিছুটা উত্তেজনাও ছড়ায়। উদয়ন এবং মডেল স্কুলে পড়–য়া দুই ছাত্র’র সাথে মডেল স্কুলের এক ছাত্রীর দৈত প্রেমের সম্পর্ক তাদের মধ্যে প্রকাশ বিরোধ ডেকে আনে। যদিও ঘটনা চক্রে সাংবাদিকের ক্যামেরার ফোকাস নিস্তব্দ করে দেয় তাদের।
শুধু বঙ্গবন্ধু উদ্যানে নয়, একই চিত্র দেখা যায় নগরীর মুক্তিযোদ্ধা পার্ক, প্লানেট পার্ক ও বদ্ধভূমি সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদীর তীড়ে। সেখানেও গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার পর থেকেই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের অবাধ মেলামেশার চিত্র চোখে পড়ে। যার মধ্যে দেখা মিলেছে মহিলা কলেজের ইউনিফর্ম পড়া কয়েকজন ছাত্রীকেও।
এ প্রসঙ্গে নগরীর সরকারি মহিলা কলেজের এক ছাত্রীর অভিভাবক সরকারি কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ছেলে মেয়ে যতক্ষন ছোট থাকে ততক্ষন তাদের প্রতি নজর রাখা সম্ভব। স্কুলে নিয়ে গিয়ে বসে থাকা সম্ভব। কিন্তু তারা যখন বড় হয় তখন আর এটা সম্ভব হয়। আবার স্কুল-কলেজ পর্যন্ত পৌছে দিয়ে আসলেও শেষ পর্যন্ত দাড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। স্কুল-কলেজে পৌছাবার পরে তারা কি করছে না করছে সেটার দায়িত্ব স্কুল কর্তৃপক্ষের নেয়া উচিৎ। কিন্তু তা হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে নিয়মিত যাচ্ছে কিনা সে বিষয়েও আমাদের কিছু জানানো হয় না। সেই সুযোগেই ওরা ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে ঘোরা ফেরা এবং আড্ডাবাজি করতে পারছে।
অবশ্য নগরীর উন্নয়ন সংগঠক ও নারী নেত্রী রহিমা সুলতানা কাজল শিক্ষার্থীদের নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ি করেছেন বাবা-মা, স্কুল-কলেজের শিক্ষক এমনকি প্রশাসনকেও। তাদের অসচেতনতার কারনেই শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিচ্ছে। এতে করে তারা পিদগ্রস্থও হচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রথমত বাবা-মায়েদের উদাসিনতা এবং দায়িত্ব বোধের অভাব রয়েছে। ছেলে মেয়েকে স্কুল-কলেজে পাঠিয়ে তারা পরবর্তীতে মনিটরিং করছে না। ক্লাশের কথা বলে ঘর থেকে বের হয়ে ছেলে মেয়ে নিয়মিত স্কুল-কলেজে যাচ্ছে কিনা তা খোঁজ নিয়ে দেখছে না তারা। কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে যাচ্ছে, কার সাথে ঘুরছে, কি করছে এটা তাদের খোঁজ খবর নেয়া খুবই জরুরী হলেও তা করছে না। বাবা-মায়ের প্রতিদিন এই কাজটা করলে ছেলে মেয়েদের মধ্যেও ভয় থাকতো। ইচ্ছা করলেও তারা ক্লাশ ফাঁকি দেয় ঘোরা ফেরা এবং অবাধ মেলামেশার সাহজ পেত না।
তিনি বলেন, দ্বিতীয়ত শিক্ষকদেরও গাফেলতি রয়েছে। তারাও শিক্ষার্থীদের নিয়মিত গাইডলাইন দিচ্ছে না। কোন শিক্ষার্থী কখন ক্লাশে আসলো, কখন বের হয়ে গেলো, কেন ক্লাশে অনুপস্থিত আবার কেন ক্লাশে এসেও চলে গেলো সে বিষয়টি তারা খোঁজ নেবার চেষ্টা করছে না। প্রতি শিক্ষার্থীর ক্লাশ ডায়েরী থাকবে। যাতে তাদের উপস্থিতি শিক্ষকরা নিশ্চিত করবে। মাস শেষে অন্তত একবার করে শিক্ষার্থীদের সমস্যা-সম্ভাবনা এবং ক্লাশে অনুপস্থিতি’র কারনগুলো নিয়ে আলোচনা করা উচিৎ। মাস শেষে একার করে হলেও শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের কাছে রিপোর্ট করা উচিৎ। কিন্তু আমাদের দেশে এই পদ্ধতি নেই। শিক্ষকরা শুধু ক্লাশ নিয়েই দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে।
তৃতীয়ত তিনি বলেন, আমাদের দেশের প্রশাসনকেও এলার্ট হতে হবে। শিক্ষার্থীরা উইনিফর্ম পড়ে ক্লাশ সময়ে অবাধ ঘোরাফেড়া এবং মেলামেশা করলেও তাদের বাঁধা দেয়া হচ্ছে না। প্রশাসন তাদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে না। প্রশাসন এলার্ট হলে আজ হয়তো পরিস্থিতি এতটা উদ্বিগ্ন হতো না।
তিনি বলেন, বর্তমান আধুনিক যুগে আজকালটার ছেলে মেয়েরা চাইলেই সব কিছু হাতের মুঠোয় পেয়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব সহ অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমে সব কিছু সহজেই সামনে পেয়ে যাচ্ছে। যা দেখে ছেলে-মেয়েরা সেদিকে উৎসাহিত হচ্ছে। তাই শুধুমাত্র লেখা-পড়ার মধ্যে সিমাবদ্ধ রাখলেই হবে না। স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে স্কুল-কলেজে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কর্মসূচির আয়োজন করতে হবে। সেখানে তাদের শেখাতে এবং বোঝাতে হবে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা বর্তমান এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারব বলে মনে করছি।
এদিকে বরিশাল জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ক্লাশ চলাকালে শিক্ষার্থীদের অবাধ মেলা-মেশার বিষয়টি আমরা দুটি দৃষ্টিকোন থেকে দেখছি। এক হলো ছেলে মেয়েরা স্কুলে যাবে, ক্লাশ চলাকালিন সময় তারা ক্লাসে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আর এটাই আমাদের কাম্য। তারা অবশ্যই ঘুরতে যাবে, তবে তা ক্লাশ চলাকালিন সময়ে নয়। বিকালে কিংবা সুবিধাজনক সময়ে। তাছাড়া বন্ধুদের সাথে নয়, তারা খুরতে যাবে বাবা-মা কিংবা ভাই বোনদের সাথে।
তিনি বলেন, দ্বিতীয়ত শিক্ষার্থীদের অবাধ মেলামেশার কারনে আবাসিক ও সামাজিক প্রভাব সৃষ্টি হওয়া। স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে তাদের অবাধ মেলামেশা অন্যকেও উৎসাহিত করতে পারে। বিনোদন কেন্দ্র কিংবা ভ্রমন স্থানগুলোতে ঘুরতে গিয়ে অন্যরা বিচলিত হতে পারে। তাই শিক্ষার্থীদের ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে বাইরে আড্ডা এবং ঘোরাফেরা বন্ধ করতেই আমরা উদ্যোগ নিয়েছি।
তিনি বলেন, প্রথমত দু’দিন আগে আমরা যে কাজটি করেছি সেটি ছিলো প্রতীকি কার্যক্রম। ক্লাশ চলাকালিন সময় আড্ডা দেয়া ছাত্র-ছাত্রীদের ধরে এনে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা দিয়েছি। ছাত্রীদের তাদের বাবা-মা এবং শিক্ষকদের হাতে তুলে দিয়েছি। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ করে শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও শতর্ক করা হয়েছে। আমাদের এই কার্যক্রম এখনো চলমান রয়েছে এবং থাকবে। আরো কিছুদিন এই কার্যক্রম চলমান থাকলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস এটা কমে যাবে।