শেবাচিম হাসপাতালের নবজাতক শিশুর বিশেষ সেবা ইউনিটে মানবিক বিপর্যয় শেবাচিম হাসপাতালের নবজাতক শিশুর বিশেষ সেবা ইউনিটে মানবিক বিপর্যয় - ajkerparibartan.com
শেবাচিম হাসপাতালের নবজাতক শিশুর বিশেষ সেবা ইউনিটে মানবিক বিপর্যয়

5:46 pm , September 12, 2018

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ শেবাচিম হাসপাতালের নবজাতক শিশুর বিশেষ সেবা ইউনিটে (স্ক্যানু) সেবিকার অভাব, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের অবহেলা, নিয়ম ভঙ্গ ও দুর্বল ব্যবস্থাপনা সহ নানা সমস্যায় প্রতিদিন নবজাতক শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। প্রতিদিন ৫-৭ নবজাতক শিশু মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে মেনে নিচ্ছে সেখানে কর্মরতরা। ইউনিট সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, শতাধিক শিশুর জন্য বিশেষ সেবা প্রদানের এই গুরুত্বপূর্ণ ওই ইউনিটে মাত্র ২ জন প্রশিক্ষণরত সহ মাত্র ৭ জন নার্স সেবা করছেন যেনতেন ভাবে। এছাড়া ইউনিটে প্রবেশের কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না আগত রোগীর স্বজনরা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কোলাহলময় এই স্থানে চুরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের অনৈতিক কর্মকান্ড ঘটছে প্রতিনিয়ত। গতকাল বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ইউনিটটিতে ৩টি শিশু বিভিন্ন কারণে মারা যায়। রোগীর স্বজনরা নিয়ম না মানলেও কর্তৃপক্ষের দুর্বল ব্যবস্থপনার নানা অভিযোগ দিয়েছেন। তারা বলেছেন, যেখানে জোরে কথা বলা নিষেধ, শিশুদের বিশেষ ও স্পর্শকাতর সেবার সেই ইউনিটের চেহারা অনেকটা মাছের বাজারের মতই। একজন সেবিকাকে ছুটে ছুটে কমপক্ষে ২০টি শিশুর সেবা করতে হচ্ছে। ওষুধসহ প্রয়োজনীয় ইনজেকশন, অক্সিজেন, স্যালাইন সেবা প্রদান করা যাচ্ছে না। তবে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পাল্টা অভিযোগ দিয়ে জানায়, রোগীর অসেচতন স্বজনদের অনিয়ন্ত্রিত অবস্থান, চলাফেরার কারণে মূলত সকল সমস্যা তৈরি হচ্ছে। যা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না কোনভাবেই। এছাড়া চাহিদানুযায়ী প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও নানা ধরণের সীমাবদ্ধতার কারণটিও একটি সমস্যা। এ কারণে শুধু নবজাতক শিশুর বিশেষ সেবা ইউনিট নয়, খারাপ অবস্থা শেবাচিমের সাধারণ ও বিশেষ সেবা দেয়া প্রত্যেকটি বিভাগের।

সমস্যা সমাধানের জন্য রোগি ও কর্তৃপক্ষের সাথে বার বার আলোচনা করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালকে লঞ্চের ডেকের সাথে তুলনা করে তারা জানায়, রোগির স্বজনদের কারণে ধারণ ক্ষমতার সমস্যা থেকেই সকল সমস্যার উৎপত্তি হচ্ছে।

গতকাল নবজাতক শিশুর বিশেষ সেবা ইউনিটে যথাসময়ে সেবার অভাবে ১৫ দিনের এক শিশুর মৃত্যু ঘটে। অক্সিজেন দেয়া অবস্থায় ঐ শিশুর বমি শুরু হলে তা পরিষ্কার না করায় শ^াস নালীতে যাওয়ায় মশিউর রহমান মহান নামের শিশুটি মারা যায়। বিকেল ৫টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। শিশুর পিতা গৌরনদীর সরিকল ইউনিয়নের আধুনা গ্রামের মোঃ মাকসুদুর রহমান মৃধা জানান, সকাল এগারোটায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত তার ছেলেকে চিকিৎসকের পরামর্শে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক শিশুর বিশেষ সেবা ইউনিটে ভর্তি করেন তিনি। গৌরনদীর আনোয়ার ক্লিনিকে তার ছেলের জন্ম হয়। হাসপাতালে আনার পর শিশুটিকে অক্সিজেন দেয়া হয় এবং তার শারীরিক অবস্থাও বিকেল পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিলো। ৫টার দিকে হঠাৎ তার ছেলে বমি করে। এসময় শিশুটির সাথে তার চাচী ছিলো। বমি করার পর নাকে দেয়া অক্সিজেনের পাইপ খুলে পরিস্কার করার জন্য সেবিকাকে এবং উপস্থিত এক ইন্টার্ন চিকিৎসককে ডাকা হয়। কিন্তু অতিরিক্ত শিশু থাকায় যথা সময়ে তারা ডাকে সাড়া দিতে পারেনি। তাই শিশুটির নাকে দেয়া অক্সিজেনের পাইপ সহ শ^াসনালীতে বমি চলে যায়। যেকারণে মারা যায় শিশুটি। এমন ঘটনা ঐ ইউনিটে রোজকার বিষয় বলে জানান শিশুটির পিতা। অন্যান্য রোগির স্বজনরা জানায়, প্রতিদিন যথাসময়ে সেবার অভাবে দুই-একটি শিশু মারা যাচ্ছেই। বিশেষ সেবাদানের ঐ ইউনিটে গতকাল মোট ১০১ নবজাতক শিশু ভর্তি ছিলো। তাদের বিপরীতে সেবাদানের জন্য মাত্র ৭ জন সেবিকা ছিলেন।

নবজাতক শিশুর বিশেষ সেবা ইউনিটে দায়িত্বরত সেবিকা সহ অন্যান্যরা জানায়, প্রতিদিন নানা সীমাবদ্ধতায় পুরো বিপরীত পরিবেশে থাকছে এই ইউনিটটি। ৫-৭টি শিশু মারা যাচ্ছে প্রতিদিন। অসচেতন রোগির স্বজনদের কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ না করতে পারায় এই সমস্যাগুলো হচ্ছে। এই ইউনিটটিতে নবজাতকদের সেবা দেয়া হয়। যেখানে সংক্রমণ একটি প্রধান সমস্যা। প্রচুর পরিমাণে রোগির স্বজনরা নিয়ম না মেনে বাইরের জিনিসপত্র, খাবার, নোংরা পোশাক পরিধান, জুতা নিয়ে প্রবেশ, মোবাইল ফোনে জোরে কথা বলার মত কাজগুলো করেই চলেছে। এতে স্পর্শকাতর শিশুরা সংক্রমিত হচ্ছে, সুস্থ হতে এসে আরো অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর দিকে ঝুুঁকে পড়ছে বা মারা যাচ্ছে। প্রতিদিন চুরির মত ঘটনাও ঘটছে এই ইউনিটটিতে। জুতা চুরি ইউনিটটির একটি অন্যতম সমস্যা বলে জানান তারা। তাদের কারণে সেবা প্রদান করা যাচ্ছে না বলে তারা আরও জানায়। যদি এক একটি শিশুর সাথে একজন করে স্বজন থাকে তাও যথেষ্ট। কিন্তু সেখানে ৪-৫ জন অবস্থান করছে প্রতিনিয়ত। যাতায়াত করছে অগণিত। তাই সেবা দেয়া তো দূরের কথা, ইউনিটে হাটা-চলাও দুস্কর হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে তারা অনিয়ম করলেও কোন শিশু মারা গেলে উল্টো দোষ চাপানো হচ্ছে সেবিকা, চিকিৎসক ও কর্তৃপক্ষের ঘাড়ে। নিয়মে আনতে গিয়ে রোগির স্বজনদের সাথে মারামারির ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু কোনভাবেই নিয়মের মধ্যে আনা সম্ভবই হচ্ছে না। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত শেবাচিম হাসপাতালে এমন শোচনীয় অবস্থা প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে বলে জানান তারা।

এবিষয়ে শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ মো. বাকির হোসেন বলেন, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত রোগী শেবাচিম হাসপাতালের সব সমস্যার মূল। ৩শ’ রোগীর সেবা দেয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন হাসপাতাল লোকবল অনুযয়ী এখন সর্বোচ্চ ৫শ’ রোগির সেবা দিতে পারে। সেখানে রোগী রয়েছে ২-৩ গুণ। তবে এর চাইতেও বড় সমস্যা রোগিদের সাথে অবস্থান করা স্বজনরা। রোগির স্বজনদের অবস্থানের কারণে হচ্ছে সংক্রমণ। বাড়ছে নবজাতক শিশুর বিশেষ সেবা ইউনিট (স্ক্যানু), কার্ডিওলজি বিভাগ এর মতো স্পর্শকাতর সেবা বিভাগে মৃত্যুর ঘটনা। অসচেতন রোগির স্বজনদের কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি। মশিউর রহমান মহান নামক শিশুর মৃত্যুর বিষয়ে তিনি বলেন, অবহেলার কারণে যদি শিশুটি মারা গিয়ে থাকে তবে কর্তৃপক্ষে কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়া উচিত রোগীর অভিভাবকের। দিলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। তবে এমন ঘটনা বন্ধ করা যাবে না যদি স্বজনরা কর্তৃপক্ষের কথা না শুনে।

অতিরিক্ত ও অসচেতন রোগির স্বজন নিয়ন্ত্রণের জন্য আনসার সদস্য চাওয়া হয়েছে। তবে সেজন্য ৪৫ লাখ টাকা জামানত দিতে হবে। এটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে যা শীঘ্রই বাস্তবায়িত হবে। তবে সচেতনতা না বাড়লে কিছুই সম্ভব না। হাসপাতালের নতুন ভবনটি চালু হলে কিছুটা স্বস্তি ফিরবে বলে জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, যে পরিমাণে সেবিকা ও চিকিৎসক বিভাগ প্রতি রয়েছে তারা যদি নির্বিঘেœ সেবা প্রদান করতে পারে আর রোগির স্বজনরা যদি হাসপাতালকে লঞ্চের ডেক না ভেবে একটি স্পর্শকাতর ও গুরুত্¦পূর্ণ স্থান ভেবে কর্তৃপক্ষের ঘাড়ে দোষ না চাপিয়ে তাদের যথাযথ কাজের পরিবেশ দেয় তবে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে। প্রতিদিন সমস্যা চিহ্নিত করে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে তিনি নিজে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন বলেও জানান।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT