5:45 pm , September 12, 2018
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ ঝালকাঠীর ভিমরুলী খালের ভাসমান পেয়ারার হাটে এবারো কোটি কোটি টাকার পেয়ারা বেচাকেনা চলছে। প্রতি বছরই শ্রাবণ থেকে আশ্বিনের মধ্যভাগ পর্যন্ত এখানে ভাসমান পেয়ারার হাট বসে প্রতিদিন। এখান থেকেই রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও নৌপথে পেয়ারার চালান যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ পেয়ারার হাট ঝালকাঠী সহ দক্ষিণাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ব্যপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রকৃতির অপার দান শাখা নদী ও খাল পরিবেষ্টিত কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ভিমরুলী গ্রামে শতবর্ষের পুরনো এ ভাসমান হাটে আশে-পাশের কয়েকটি গ্রামের পেয়ারা নিয়ে ছুটে আসছেন উৎপাদনকারীরা। শুধুমাত্র কীর্তিপাশা ইউনিয়নেরই প্রায় ৫শ’ হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষ হচ্ছে। এছাড়াও আটঘর-কুড়িআনা সহ পিরোজপুরের নেছারাবাদেরও বেশ কয়েকটি গ্রামের আরো কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে পেয়ারার চাষ হচ্ছে। পেয়ারাই এ এলাকার অর্থনীতির একটি বড় অংশ জুড়ে আছে। এ পেয়ারার হাটকে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকদেরও সমাগম ঘটছে ভিমরুলিতে।
অনাদিকাল ধরে ঝালকাঠী ও পিরোজপুরের কয়েকটি গ্রামে স্থানীয় লাগসই প্রযুক্তিতে পেয়ারার আবাদ হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এসব পেয়ারা বাগানেই দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধরা ঘাটি করে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে রণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। এমনকি সিরাজ সিকদার আটঘর কুড়িআনার পেয়ারা বাগানে বসেই তার দলের এক অনানুষ্ঠানিক সম্মেলনের মাধ্যমে ‘পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি’ গঠন করেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে। আর এ সবেরই খেসারত হিসেব পাক বাহিনী আটঘর কুড়িআনার পেয়ারা বাগান সহ আসেপাশের গ্রামগুলোতে অভিযান চালিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যা সহ পুরো বাগান ধংস করে দেয়। ফলে স্বাধীনতা পরবর্তী কয়েকটি বছর এখানে কোন পেয়ারার উৎপাদন হয়নি। ফলে ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ এ এলাকায় থাবা বসায়। তবে বছর পাঁচেকের মধ্যে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। ধীরে ধীরে এলাকাবাসী পুনরায় পেয়ারা বাগান তৈরী করে পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তনে সক্ষম হন।
সে থেকে স্থানীয় প্রযুক্তিতেই ঝালকাঠীর আটঘর-কুড়িআনা ও কীর্তিপাশা ছাড়াও পিরোজপুরের নেছারাবাদ এলাকা সহ আসে পাশের গ্রামগুলোতে বিপুল পরিমান পেয়ার উৎপাদিত হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসরন অধিদপ্তরের মতে, দেশে প্রতিবছর যে প্রায় ২ লাখ টনের মত পেয়ারা উৎপাদিত হচ্ছে, তার সিংহভাগই ঝালকাঠী ও পিরোজপুরের বাগান থেকে আসছে। এছাড়াও চট্টগ্রামের কাঞ্চন নগর ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার মুকুন্দপুরেও বিপুল পরিমান পেয়ারা উৎপাদিত হচ্ছে।
তবে ঝালকাঠী ও পিরোজপুরের পেয়ারা বাগানের কিছু আলাদা বৈশিষ্ট রয়েছে। এসব এলাকায় ছোট নদীর ধারের জমির চারদিকে নালা তৈরী করে তার মাঝের ঢিবিতে পেয়ারা গাছ লাগান হয়। ফলে শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনে সেচ দেয়া সহ গাছের জন্য প্রয়োজনীয় আর্দ্রতারও খুব একটা ঘাটতি হয়না। এমনকি ঐ সব নালা ব্যবহার করে পেয়ারা তোলা থেকে পরিবহন সহ সব কিছুই করা হচ্ছে নৌকায়। গাছ থেকে সরাসরি নৌকায় করে এসব পেয়ারা চলে আসে ভিমরুলির ভাসমান হাটে। সেখানে পাইকাররা বাগান মালিকদের কাছ থেকে পেয়ারা কিনে দেশের বিভিন্নস্থানে তা চালান করছে। তবে অনেক ফড়িয়ারা আবার পুরো বাগান সহ পেয়ারা কিনে তা পরিচর্যার মাধ্যমে বড় করে এহাটে নিয়ে এসে পাইকারদের কাছে বিক্রি করে থাকে।
সাম্প্রতিককালে ভিমরুলীর এ ভাসমান পেয়ারার হাট ও আশেপাশের বাগান দেখতে প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে বিপুল সংখ্যক মানুষ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসছে। ফলে এ হাটকে ঘিরে অন্যন্য ব্যবসারও সম্প্রসারণ ঘটছে। ঝালকাঠী লঞ্চ ঘাট থেকে নৌপথে বা বরিশাল মহানগরী থেকে সড়ক পথেও ভিমরুলিতে যাতায়াত খুব সহজ।
পেয়ারা আমাদের দেশীয় ফলের মধ্যে ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ একটি পুষ্টিকর খাবার। এর প্রতি ১শ’ গ্রাম খাদ্যোপযোগী অংশে ২১০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ভিটামিন-সি রয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর বিজ্ঞানীগন ‘কাজী পেয়ারা’, ‘বারি পেয়ারা-২’ ও ‘বারি পেয়ারা-৩’ সহ বেশ কয়েকটি উন্নত ও পুষ্টিকর জাতের পেয়ারার জাত উদ্ভাবন করেছেন। এসব পেয়ারার হেক্টর প্রতি ফলন ২৮ থেকে ৩০ টন পর্যন্ত হয়ে থাকে।
তবে পিরোজপুর-ঝালকাঠী এলাকার চাষীদের মধ্যে এখনো সনাতন জাতের দেশীয় পেয়ারা আবদেই আগ্রহ বেশী। তাদের মতে, দেশীয় এসব জাতের পেয়ারার স্বাদই আলাদা। তাই পুরনো জনপ্রিয় স্বাদের এসব পেয়ারা যেমনি সবকাছে বেশি প্রিয়, তেমনি তা আবাদে তারা সব সময়ই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।