5:44 pm , September 12, 2018

সাঈদ পান্থ ॥ বরিশাল সিটি এলাকা থেকে থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে উজিরপুর উপজেলার সাতলা ইউনিয়নের উত্তর সাতলা গ্রাম। গ্রামের নামেই বিলের নাম সাতলা বিল। লাল আর সবুজের মাখামাখি দূর থেকেই চোখ পড়বে পর্যটকদের। কাছে গেলে ধীরে ধীরে সবুজের পটভূমিতে লালের অস্তিত্ব আরো গাঢ় হয়ে ধরা দেবে। চোখ জুড়িয়ে দেবে জাতীয় ফুল শাপলার বাহারি সৌন্দর্য। আগাছা আর লতাগুল্মে ভরা বিলের পানিতে ফুটে আছে হাজার হাজার লাল শাপলা। সূর্যের সোনালি আভা শাপলা পাতার ফাঁকে ফাঁকে পানিতে প্রতিফলিত হয়ে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বিলের সৌন্দর্য। নৌকা কিংবা হাঁটুপানি মাড়িয়ে বিলের ভেতর ঢুকলে মনে হবে বাতাসের তালে তালে এপাশ-ওপাশ দুলতে দুলতে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে শাপলারা। সে হাসিতে বিলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আনন্দধারা।
তবে শাপলার রাজত্বের কারণে এখন শাপলা বিল নামেই বেশি পরিচিত সাতলা। ইতিমধ্যে বরিশালের গন্ডি ছাড়িয়ে বিলের কথা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। অন্যান্য স্থানে, বিশেষ করে শহরে ইট-পাথরে বন্দি জীবন কাটানো মানুষ প্রশান্তির আশায় ছুটে আসে এ বিলে। শীত মৌসুমে পর্যটকের ভিড় বাড়ে। তবে সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারী মাস পর্যন্ত চলে এই শাপলার রাজত্ব্য। পর্যটকদের প্রশান্তি বিলানো ছাড়াও এই বিল ও তার শাপলা স্থানীয়দের অন্নেরও জোগান দেয়।
সম্প্রতি সাতলার নয়াকান্দি বিল (পশ্চিম কালবিলা) ঘুরে দেখা যায়, আগাছা ঠেলে অনেকেই নৌকা নিয়ে বিলের গহিনে যাচ্ছে। বিল থেকে শাপলা তুলে জমা করছে নৌকায়। কেউ বা ব্যস্ত মাছ ধরায়। বিল থেকে শাপলা তুলে অনেকে তা বিক্রি করে স্থানীয় বাজারে। মাছ বিক্রি করেও সংসার চালায় অনেকে। আবার নতুন করে পেশা তৈরি করেছেন এখানকার অনেকেই। বিলে নৌকা চালিয়ে পর্যটকদের কাছ থেকে পরিশ্রমি নিচ্ছেন। প্রায় ৮ বছর ধরে এ বিল নিয়ে কাজ করছেন ইসহাক খান। পেশায় এক জন কৃষক হলেও তিনি এখন তার পেশা পরিবর্তন করে বিলে নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সঙ্গে করে পর্যটক নিয়ে বিলে বিলে ঘুরছেন তিনি। তিনি বলেন, উজিরপুরের সাতলা এবং পাশের আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগধা ইউনিয়নের বাগধা ও খাজুরিয়া গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে বিছিয়ে আছে শাপলার বিল। বিলের সঠিক আয়তন জানা নেই কারো। তবে স্থানীয়দের মতে, প্রায় ২০০ একর জমির ওপর প্রাকৃতিকভাবে বিলটি গড়ে উঠেছে। স্থানীয়দের অনেকে জীবিকার জন্য বছরের একটা বড় সময় বিলের মাছ ও শাপলার ওপর নির্ভরশীল।
বিলে ঠিক কত আগে থেকে এভাবে শাপলা জন্মাতে শুরু করেছে, সে তথ্যও দিতে পারেনি স্থানীয়রা। বরিশাল নগরী থেকে উজিরপুরের সাতলার নয়াকান্দি বিলে ঘুড়তে যাওয়া শারমিন লুনা জানান, ‘প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে। তার ভিতরে সাতলা একটি অন্যতম স্থান। এই স্থানটিতে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়। যদি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও স্থানীয়দের উদ্যোগ থাকে তবে তা করা সম্ভব। ’ সাতলার সাতলার নয়াকান্দি বিল এলাকার যুবক কলিমুল্লাহ বলেন, তাঁদের জন্মের পর থেকেই বিলে এভাবে শাপলা ফুটতে দেখছেন তাঁরা। এ বিলে তিন ধরনের শাপলা জন্মে লাল, সাদা ও বেগুনি রঙের। তবে লাল শাপলাই বেশি। এর পর সাদা। সাধারণত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বিলে শাপলা থাকে।
সাতলা গ্রামের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, এলাকার অনেক মানুষই এখন শাপলার উপর জীবিকা নির্বাহ করছেন। সাদা শাপলা রান্না করে খাওয়া অনেক পুষ্ঠিকর। এছাড়া শাপলায় অনেক আয়রন থাকে। লাল শাপলার কদর থাকলেও এটি রান্না করতে অতিরিক্ত ঝামেলা পোহাতে হয়। লাল শাপলা সরাসরি রান্না করার পরও কিছু কালচে রং থাকে। তাই রান্নার আগে তা সিদ্ধ করে নিতে হয়। তিনি বললেন, আগে বিলে প্রচুর শাপলা জন্মালেও এখন পলি পড়ে বিল ভরাট হতে থাকায় পানি কমে যাচ্ছে, ফলে আগের চেয়ে কমে যাচ্ছে শাপলার উৎপাদন। বিলের বিভিন্ন অংশে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের কারণেও শাপলা কমে যাচ্ছে।
বিলসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা শ্যামল বৈদ্য তাঁর ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে প্রতিদিনই বিলের পানিতে মাছ ধরেন। তিনি জানান, প্রতিদিন প্রায় ৩০০ বড়শি পেতে তিনি মাছ ধরেন। কই, খলিশা, টাকি, শোল, পুঁটিসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে। মাছ বিক্রি করে দিনে প্রায় ৪০০ টাকা আয় হয় তাঁর। একই এলাকার বাসিন্দা বসন বৈদ্য জানান, তিনি অন্যের জমিতে কাজ করেন। তবে শাপলার মৌসুমে শাপলা তুলে বাজারে বিক্রি করেন। সেই টাকায় তাঁর সংসার চলে। তাঁর মতো শতাধিক পরিবার এভাবে টিকে আছে। তিনি জানান, ১৫ থেকে ২০টি শাপলার একটি আঁটি তিন থেকে পাঁচ টাকায় বিক্রি হয়। শাপলা বিক্রি করে দিনে তাঁর প্রায় ৩০০ টাকা আয় হয়। এ বিলের শাপলা বরিশাল, পিরোজপুর ও ফরিদপুরের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করা হয়।
এব্যাপারে বরিশাল জেলা প্রশাসক মো: হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সাতলা নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে সাতলাকে পর্যটন কেন্দ্র করার বিষয়ে পর্যটন কর্পোরেশনকে অবহিত করা হয়েছে। আমি নিজেও স্থানটি ভিজিট করতে আগামী শুক্রবার যাচ্ছি। এছাড়া স্থানীয়ভাবেও সেখানে রেস্টুডেন্ট করার বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যেখানে পানি, বাথরুম এর ব্যবস্থা থাকবে। ’