6:03 pm , August 3, 2018

সাঈদ পান্থ ॥ নগরীর দৃস্টি নন্দন বস্তুটি হচ্ছে ঐতিহ্যবাহি বিবির পুকুর। আধুনিক নগরায়নের কারণে দিনে দিনে কমছে এই নগরীর পুকুর, জলাশয় ও খালের। এ অবস্থায় নগরীর প্রতিটি মানুষের নানা দাবী মধ্যে চলে আসে এই বিবির পুকুরকে কেন্দ্র করে। এই পুকুরটি নগরীর প্রাণকেন্দ্রে শতবছরের চিহ্ন ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। তাই যে সরকার বা যে দলের মেয়রই দায়িত্বে থাকেন তারা এই পুকুরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রকল্প দেন। নগরীর ঐতিহ্যের এই স্মারককে রক্ষা ও এর সৌন্দর্যবর্ধণের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১২ সালে। সেই কাজ দীর্ঘ ৬ বছরেও শেষ হয়নি। বরং পুকুরের চারপাশে যেটুকু কাজ হয়েছিল তাও অযতœ-অবহেলায় পড়ে আছে। উঠিয়ে নেয়া হয়েছে কোটি টাকায় স্থাপণ করা লাইটিং ফোয়ারা।
জানা গেছে, বিবির পুকুর ১১১ বছরের পুরেনো। বর্তমানে এটি নগরীর অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র। বিকালে ও সন্ধ্যায় নগরবাসী অবসর সময় কাটানোর জন্য পুকুর পাড় ও সংলগ্ন হিরন স্কয়ারে জড়ো হন। প্রতিদিনই অনেক রাত পর্যন্ত পুকুর পাড় থাকে জমজমাট। বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরন ২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর বিবির পুকুর রক্ষা ও এর সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্যোগ নেন। ২০১২ সালের ২৭ মে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ও গ্রামীণফোনের অর্থায়নে বিবির পুকুর সৌন্দর্য বর্ধন প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। প্রকল্পের আওতায় রয়েছে পুকুরের চারপাশে ঝুলন্ত পার্ক, বসার বেঞ্চ, অত্যাধুনিক গ্রিল ও পুকুরের শোভা বৃদ্ধির জন্য লাইটিং ও ফোয়ারা স্থাপন। পাশাপাশি বিবির পুকুরের পাশেই করা হয় উন্মুক্ত বিনোদন কেন্দ্র। মেয়র হিরনের মৃত্যুর পর তা ‘হিরন স্কয়ার’ নামে পরিচিতি পায়। প্রকল্পের সমন্বয়কারী মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, এক কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে বিবির পুকুরের সৌন্দর্য বর্ধন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বিবির পুকুরের ইতিহাস এক নজরে জানতে এর উত্তর পাশে থাকবে একটি বোর্ড। থাকবে মিউজিক্যাল রঙিন ফোয়ারা। পুকুরের চারপাশে রোপন করা হবে বিভিন্ন প্রকারের গাছ। থাকবে উন্নত ওয়াকওয়ে। তিনি বলেছিলেন, নগরীর প্রাণকেন্দ্রের পরিবেশ পাল্টে দেওয়াই এ প্রকল্পের লক্ষ্য।
তবে বিবির পুকুরের চারপাশে রয়েছে ওয়াক ওয়ে হয়েছে। কিন্তু প্রতিশ্রুত অনেক কিছুই এখনও করা হয়নি। কিছু কাজ করা হলেও তা ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে। প্রকল্প এলাকার রক্ষণাবেক্ষণেও কোনও উদ্যোগ নেই। প্রকল্পের লাইটিং ও ফোয়ারার কাজ পেয়েছিলেন বিসিসির সাবেক একজন কাউন্সিলর। ফোয়ারা নির্মাণের পরপরই তাতে ত্রুটি দেখা দেয়। বর্তমানে ফোয়ারা দুটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ধসে পড়েছে ওয়াকওয়ের রেলিং। রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনী ব্যানার-বিলবোর্ডে ঢেকে যাচ্ছে পুকুরের চারপাশ। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে গড়ে ওঠেছে রেন্ট-এ-কারের গাড়ি পার্কিং। সেখানেই গাড়িও ধোয়া হয়। বিনোদন পিয়াসীদের জন্য উপদ্রব হয়ে দেখা গিয়েছে পশ্চিম পাড়ে খোলা ডাস্টবিনের বিকট দুর্গন্ধ। উত্তর ও পশ্চিম পাড়ের অরক্ষিত ওয়াকওয়ে এবং বসার ব্যবস্থ না-থাকায় তা অনেক সময় হকারদের দখলে চলে যায়। এদিকে চলতি বছরে ২০ লাখ টাকায় বিবির পুকুর পাড় বিক্রির অভিযোগ উঠেছে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে। তারা এক মোবাইল কোম্পনীর ১২টি বিল বোর্ড স্থাপন করেছেন এই পুকুর পাড়ে।
গত ৩০ জুলাই বরিশাল সিটি নির্বাচনে ভোট দিতে আসা ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাবিলা রহমান বলেন, ‘ছুটিতে বরিশালের বাসায় এলেই সন্ধ্যায় ছুটে আসি এখানে। জায়গাটি খোলামেলা ও নগরীর কেন্দ্রস্থলে হওয়ায় পরিবেশ ও যাতায়াত সুবিধা ভালো। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডাও জমে, ভ্যানে বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবারও পাওয়া যায়। তবে বিলবোর্ডে পুকুরের পাড়গুলো অনেক সময় ঢাকা পড়ে যায়। পুকুর পাড়ে আড্ডা দেয়া বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র সুমন, শাহীন বলেন, ‘বিসিসি এ এলাকায় ওয়াই-ফাই জোনের ব্যবস্থা করায় তরুণদের ভিড় হয় বেশি। আমাদের আড্ডাবাজিও এই পুকুরকে কেন্দ্র করে। সেখানে থাকা ষাটোওর্ধ্ব বৃদ্ধ হারুন-অর রশিদ বলেন, একসময় এ পুকুরের সঙ্গে কীর্তনখোলা নদীর যোগাযোগ থাকায় নিয়মিত জোয়ার-ভাটায় এর পানি ভালো থাকত। এ ব্যবস্থাটি আবারও চালু করতে হবে। প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা গেলে অবস্থার আরও উন্নতি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (ফেনির জেলা প্রশাসক হিসেবে ঘোষনা আসা) মো: ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী এই পুকুরকে আরও আধুনিক বিনোদন স্পট হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বর্তমানে ৮ কোটি টাকার একটি পরিকল্পনা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সে পরিকল্পনা অনুমোদন ও অর্থ বরাদ্দ হলেই এর বাস্তবায়ন শুরু হবে। ’ তিনি বলেন, ‘ফোয়ারার নির্মাণকাজ সরাসরি গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ করেছে। আমরা তদারকি করেছি মাত্র। আজ পর্যন্ত তারা বিসিসির কাছে এটি হস্তানন্তর করেনি। ’
শোনা যায়, খ্রিষ্ট ধর্মের প্রখ্যাত প্রচারক ডা. উইলিয়াম কেরির নাতি উইলিয়াম কেরি জুনিয়র বরিশালে এসে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন স্থানীয় ভূস্বামিনী জিন্নাত বিবির শুশ্রুষায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। পরে জিন্নাত বিবিকে বিবি-জেনেট নাম দিয়ে পালিতা কন্যার মর্যাদা দেন উইলিয়াম কেরি জুনিয়র। ওই সময় স্থানীয়দের পানীয় জলের কষ্ট নিরসনের জন্য জিন্নাত বিবি একটি পুকুর খননে উইলিয়াম কেরি জুনিয়রের সহায়তা চান। সে অনুসারে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলা সদর বরিশাল শহরের প্রধান সড়ক সদর রোডের পূর্বপাশে ৪০০ ফুট প্রস্থ ও ১৮৫০ ফুট দীর্ঘ একটি পুকুর খনন শুরু হয়। কাজটি ১৯০৮ সালে শেষ হয়। জিন্নাত বিবির কোন সন্তান ছিল না। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে তিনি বাস করতেন। ওই এলাকার নাম ছিল বিবির মহল্লা। পুকুরটিও কালক্রমে বিবির পুকুর হিসেবে পরিচিত লাভ করে।