7:03 pm , April 23, 2018

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ গণ গ্রেফতার আতংকে ব্যাটারীচালিত রিক্সা শূণ্য নগরী। এছাড়াও ঘর ছেড়ে আত্মগোপনে রয়েছে চালকরা। রোববার গভীর রাতে ১১ রিক্সা চালককে গ্রেপ্তার ও ঘরে অভিযান চালানোর পর থেকে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশের করা মামলার আসামী হিসেবে ১১ রিক্সা চালককে গতকাল সোমবার আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িত নয় এমন রিক্সা চালকদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এসব কারনে পালিয়ে থাকা প্রায় তিন হাজার শ্রমিকের পরিবার না খেয়ে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে। এদিকে ব্যাটারী রিক্সা শুন্য নগরীতে মনুষ্য চালিত রিক্সা চালক অন্যান্য গণপরিবহন যাত্রীদের জিম্মি করে আদায় করছে অতিরিক্ত ভাড়া।
জানা গেছে, বাসদ বরিশাল জেলা’র সদস্য সচিব ডা. মনিষা চক্রবর্তী’র নেতৃত্বে দীর্ঘ দিন ধরেই নগরীতে ব্যাটারি রিক্সা চলাচল এবং তাদের লাইসেন্স প্রদানের দাবীতে আন্দোলন করে শ্রমিক-মালিক সংগ্রাম কমিটি। গত ১৯ এপ্রিল দাবী আদায়ের জন্য নগরীতে মানববন্ধন শেষে ভুখা মিছিল করে ব্যাটারী রিকশা শ্রমিক-মালিক সংগ্রাম কমিটি। তারা প্রথমে নগর ভবনের সামনে সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে। সেখান থেকে ফিরে ফজলুল হক এভিনিউ সড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে। তখন পুলিশ তাদের বাঁধা দেয়। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির এক পর্যায় পুলিশ বাসদ নেতৃবৃন্দ ও রিকশা শ্রমিকদের উপর এলোপাতারী লাঠিচার্জ শুরু করে। সেখান থেকে আটক হয় বাসদ বরিশাল জেলার আহ্বায়ক প্রকৌশলী ইমরান হাবিব রুম্মন, সদস্য সচিব ও বাসদ’র মনোনীত মেয়র প্রার্থী ডা. মনিষা চক্রবর্তী সহ ৬ জনকে। সংঘর্ষে এসি এবং ওসি সহ ৬ জন আহত হয়েছে বলে দাবী পুলিশের। এমনকি এমন অভিযোগ এনেই বাসদের ওই ছয় নেতৃবৃন্দকে নামধারী এবং ৬০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী করে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে পুলিশ।
মামলা করেই শুরু হয় ব্যাটারি রিক্সা শ্রমিকদের ধরপাকড়। সদর রোডসহ নগরীর প্রায় প্রতিটি রাস্তার মোড়ে মোড়ে চেক পোষ্ট বসিয়ে ব্যাটারিচালিত রিক্সা দেখা মাত্রই চালককে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গভীর রাতে যাত্রীদের রিক্সা থেকে নামিয়ে দিয়ে রিকশা সহ চালককে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে থানায়। গত ১৯ এপ্রিল রাত থেকে শুরু হওয়া অভিযানে আটক হয় অসংখ্য রিকশা শ্রমিক। যার মধ্যে শুধুমাত্র ২২ এপ্রিল রাতেই আটক হয়েছে ১১ জন। অথচ এদের পরিবারের সদস্যদের অনেকে অভিযোগ বিনা দোষে শ্রমিকদের গ্রেপ্তার করে পুলিশের মামলায় অজ্ঞাতনামার তালিকায় আসামী করা হচ্ছে।
আটক হওয়া শ্রমিকদের পাশাপাশি পালিয়ে থাকা অন্যান্য শ্রমিকদের স্বজনরা নিজেদের পরিস্থিতি এবং অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে বলেন, ঋনের টাকায় একটি ব্যাটারি রিক্সা কিনে তা দিয়ে সংসার ও ছেলে মেয়েদের লেখা-পড়ার খরচ যোগার হতো। সেই টাকা দিয়েই আবার পরিশোধ করা হয় ঋন। কিন্তু পুলিশের ভয়ে এখন আর রিকশার চাকা ঘুরছে না। চলছে না ঘরের বাজার। অর্ধাহার অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। সন্তানদের লেখা-পড়াও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম ঘটেছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগি পরিবারগুলো।
৯৫ বছর বয়সী ব্যাটারীর রিকশা চালক আকবর মিয়া বলেন, দিন আনি, দিন খাই। বয়স্ক ভাতাও পাই না। প্যাডের লইগ্যা ধার দেনা কইরা একটা রিকশায় ব্যাটারী ইঞ্জিন লাগাল্লাম। এইডা দিয়াই কোনরকম কামাই রোজগার দিয়া খাইয়া-পর্ইরা বাইচ্চা আল্লাম। কিন্তু পুলিশ মোগো কামাই’র হেই রাস্তাও বন্ধ কর্ইরা দেছে।
৭৫ বছয় বয়সী আব্দুল খালেক হাওলাদার বলেন, তিন মাইয়া বিয়া দিছি। হের ফান্নে অনেক টাহা খরচ অইছে। মাইয়াগো অবস্তাও বেশি সুবিধার না। ঘরের জনরে লইয়া কষ্টের মইধ্যে আছি। আশা সমিতি দিয়া লোন উডাইয়া ব্যাটারী রিকশা বানাইল্লাম। রাইতে রাইতে হেইডা চালাইয়া যা আয় হয় হেইয়া দিয়া সংসারডা চইল্লা যাইতে। এহন রিকশা বন্ধ হর্ইরা খয়রাত করা ছাড়া আর কোন দিক খুইজ্জা পাইনা। পাওনাদারের ভয়ে বাসায় যাইতি পারি না। আমরা গরিব, হের ফাইন্নে আমাগো কষ্ট কেউ দেহে না। পুলিশ ধইর্যা লইয়া যায়। কেডে ছাড়াই আনবে। মোগো কেউ নাই। হেরই ফান্নে রিকশাডা ঘরের মধ্যে গুজাই রাখছি। নিজেও কামাই করতে বাইরাইতে পারি না।
বান্দ স্টেডিয়াম কলোনির বাসিন্দা রিকশা চালক শফিক বলেন, ভাড়ায় রিকশা চালাই। ১৯ তারিখের পর দিয়া আর রিকশা চলাই রাস্তায় যাইতে পারি না। হুনছি, পুলিশ য্যারে পায় হ্যারেই ধর্ইরা নেয়। নিজেই খাইতে পারি না, হ্যার মধ্যে পুলিশ ধরই নেলে মামলা চালাইবে কেডা এর মহাজনরে রিকশার ভর্তুকি দেবে কেডে। এর থেইক্কা জোগাইল্লার কাম খুজতে আছি।
আকবর, খালেক মিয়া আর শফিকের মতো আরো অনেক রিকশা শ্রমিক তাদের কষ্টের কথা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের কাছে। এসব রিকশা চালকদের এখন একটাই মামলায় ফেলে হয়রানি নয়, বরং যারা অপরাধী তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার পাশাপাশি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবিকা নির্বাহনের পথ সহজ করে দেয়া।