7:01 pm , June 13, 2018

রুবেল খান ॥ বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ন ওয়ার্ড হচ্ছে ১৬নং ওয়ার্ড। বিএনপি অধ্যুষিত এই ওয়ার্ডটিতে মেয়র কিংবা সংসদ নির্বাচনে বিজয় বিএনপি’র অনুকুলেই থাকছে। তবে কাউন্সিলর নির্বাচনের ক্ষেত্রে ঘটছে ব্যতিক্রম। ওয়ার্ড প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ক্লিন ইমেজ, উন্নয়নমুখী ও সজ্জন ব্যক্তিকেই খুঁজে নিচ্ছেন ভোটাররা। সে হিসেবে আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দুই হেভিওয়েট প্রার্থীকে নিয়েই ভাবছেন তারা। ১৬নং ওয়ার্ডে এরই মধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে একাধিক ব্যক্তির নাম উঠে আসলেও বিগত বছরের ন্যায় এবারেও ওই দুই প্রার্থীর মধ্যেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে মনে করছেন ভোটাররা। যেমনটি হয়েছে ২০১৩ সালের নির্বাচনে। এই দুই প্রার্থী হলেন ১৬নং ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও একই স্থানে দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর ধরে জনপ্রতিনিধিত্ব করে আসা আওয়ামী লীগ নেতা মোশারেফ আলী খান বাদশা এবং ওয়ার্ডবাসীর আস্থভাজন আওয়ামী লীগ নেতা মো. সাহিন সিকদার। অবশ্য দু’জনের মধ্যে মোশারেফ আলী খান বাদশা প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিলেও দলের হাই কমান্ড অর্থাৎ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ ও মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ’র অনুমতি’র অপেক্ষায় আছেন মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সাহিন সিকদার।
ওয়ার্ডটিতে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে অন্যান্যদের মধ্যে যারা রয়েছেন, তারা হলেন মহানগর যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ১৬নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান রতন এবং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এএসএম রাফি জুয়েল। তারা নির্বাচনের জন্য চুড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
জানাগেছে, ১৯৯৪ সালে প্রথমবারের মত তৎকালিন বরিশাল পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন মোশারেফ আলী খান বাদশা। সেই থেকে বর্তমান ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৬নং ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সর্বশেষ ২০১৩ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মোশারেফ আলী খান বাদশা। ওই নির্বাচনে মাত্র ৯ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন তিনি। ২০১৩ সালের নির্বাচনে তার পার্শ্ব প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী ছিলেন মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. সাহিন সিকদার।
এদিকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী শক্তসমর্থ হলেও মোশারেফ আলী খান বাদশা’র নির্বাচনী মেকানিজামে ধরাশায়ী হতে হচ্ছে তারা। নির্বাচনে ডামি প্রার্থী রাখাটা তার নির্বাচনের একটি ভিন্ন কৌশল। প্রতি নির্বাচনেই নিজের বিকল্প প্রার্থী হিসেবে কাউকে না কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামাচ্ছেন। যেমনটি ২০১৩ সালের নির্বাচনে করেছিলেন। ওই নির্বাচনে মোশারেফ আলী খান বাদশা তার সহধর্মীনিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামান। যদিও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকলেও প্রচার-প্রচারনায় ছিলেন না কাউন্সিলরের সহধর্মীনি। এবারের নির্বাচনেও একই পন্থা অবলম্বনের ইঙ্গিত দিয়েছেন মোশারেফ আলী খান বাদশা। তবে তা পরিস্থিতি বুঝে।
জানাগেছে, গত ২৫ বছর জনপ্রতিনিধিত্ব কালে এ যাবৎ চার বার প্যানেল মেয়র এবং প্যানেল চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। দু’বার কাউন্সিলরদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও দু’বার ভারপ্রাপ্ত প্যানেল মেয়র এর দায়িত্ব পালন করেছেন মোশারেফ আলী খান বাদশা।
আলাপকালে মোশারেফ আলী খান বাদশা বলেন, দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর ধরে ওয়ার্ডে জনপ্রতিনিধিত্ব করে আসছি। সর্বদা ওয়ার্ডবাসির উন্নয়ন ও জনকল্যানে কাজ করার চেষ্টা করেছি। রাস্তা, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বৈদ্যুতিক আলো, পয়নিস্কাশন, সুপেয় পানি, স্যানিটেশন ব্যবস্থা সহ এমন কোন উন্নয়ন নেই যে আমার ওয়ার্ডটিতে বাকি আছে। তাই জনগনের ভালোমন্দ এবং সুখে-দুঃখে পাশে থাকার জন্যই পুনরায় নির্বাচনে অংশগ্রহন করবো। পরবর্তী কি উন্নয়ন করবো সেটা বড় কথা নয়, নির্বাচিত হলে পরম শত্রুকেও কোন প্রকার ক্ষতি করার চেষ্টা করবো না। যা পূর্বেও করিনি। পারলে তাদের উপকার করেছি এবং ভবিষ্যতেও করার ইচ্ছা রয়েছে। তাছাড়া আমার ওয়ার্ডটিতে কোন উন্নয়ন বাকি নেই। খুটিনাটি সমস্যা ধরা পড়লে বা উন্নয়নের প্রয়োজন হলে তা চিহ্নিত করে সমাধানে যথাপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন করবো।
অপরদিকে ওয়ার্ডে ঘুরে জানাগেছে, ১৬নং ওয়ার্ডে মোশারেফ আলী খান বাদশা’র সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হওয়ার মত একজন প্রার্থীই আলোচনায় আছেন। তিনি হলেন যুবলীগ মহানগর কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সাহিন সিকদার। ২০১৩ সালের নির্বাচনেও মোশারেফ আলী খান বাদশা ও সাহিন সিকদারের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। তাদের জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে মাত্র ৯ ভোটের ব্যবধান ছিলো। এবারেও তাদের দু’জনের মধ্যেই তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আশংকা করছেন ভোটাররা। কেননা বিগত বারের থেকে এবারেও সাহিন সিকদারের জনসমর্থন আরও বেড়েছে। গত নির্বাচনে তিনি সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাস্ত হলেও জনসেবা থেকে থেমে থাকেননি। বরং নিজ অর্থায়নে উন্নয়ন ও জনকল্যানমুখি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। এসব কারনে তার জনসমর্থন অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
জানাগেছে, সাহিন সিকদার দীর্ঘ বছর ধরেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। তৎকালিন বিএনপি সরকারের সময় অর্থাৎ ২০০৩ সালের ১৫ই আগস্ট জাতীর জনকের পোষ্টার লাগাতে গিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোটের হামলার শিকার হন সাহিন সিকদার। এসময় তাকে কুপিয়ে জখম করে হামলাকারীরা। তাকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছে দীর্ঘ দিন। এছাড়া ২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে আন্দোলন থেকে গ্রেপ্তার হন সাহিন সিকদার। তার বিরুদ্ধে ৩টি মামলা দিয়ে জেলে প্রেরন করা হয়েছিলো। ওই মামলায় দীর্ঘ ২ মাস কারাবরণও করতে হয় সাহিন সিকদারকে।
যুবলীগ নেতা শাহিন সিকদার বলেন, আমি জনগনের সেবায় রাজনীতি করি। এখানে কিছু পাওয়া না পাওয়ার হিসাব নেই। ২০১৩ সালের নির্বাচনে আমি ১৬নং ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। সেখানে জনগন আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা তারা রেখেছেন। তারা আমাকে ভোট দিয়েছেন বিধায় সামান্য ভোটের ব্যবধানে আমি পরাজিত হয়েছি। তাই আমিও জনগনকে দেয়া ওয়াদা পালনের চেষ্টা করেছি। নির্বাচনে পরাজিত হলেও জনগনের উন্নয়ন এবং সেবা থেকে ফিরে আসিনি। বরং জনপ্রতিনিধি না হয়েও নিজ উদ্যোগে এলাকার যে উন্নয়ন করেছি তা কোন জনপ্রতিনিধিও করতে পারেনি। বিগত ১০ বছর ধরে ব্যক্তি উদ্যোগ এবং নিজ অর্থায়নে দুটি গাড়ি ব্যবহার করে ময়লা আবর্জনা অপসারন করাচ্ছি, নিজ অর্থায়নে ফগার মেশিন এর সাহায্যে মশার ওষুধ দিয়ে আসছি। ওয়ার্ডের মধ্যে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা এবং পরীক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষার উপকরণের ব্যবস্থা করে আসছি। অস্বচ্ছল পরিবারগুলোতে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে দিতে তাদের সাহায্য সহযোগিতা করেছি। মাদক থেকে যুব সমাজকে দুরে রাখতে এলাকায় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে আসছি। পিডিবি’র সহায়তায় নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করেছি। শুধু তাই নয়, ওয়ার্ডের নারীদের সুবিধার্থে তাদের হাটার জন্য ব্রাউন কম্পাউন্ড রোডের ভেতরে পুকুরটির চারপাশে ওয়াকওয়ে নির্মান কাজ চলমান রয়েছে। যেখানে ওয়ার্ডের নারীরা সকাল-বিকাল হাটাচলা করতে পারবে। ব্রাউন কম্পাউন্ড মসজিদ ভিত্তিক বিভিন্ন কাজ করেছেন সাহিন সিকদার। বিশেষ করে রোজার মধ্যে মুসল্লীদের নামাজ পড়তে যাতে সমস্যায় পড়তে না হয় সে জন্য নিজ অর্থায়নে প্যান্ডেলের ব্যবস্থা করেন তিনি। শুধু রমজান মাসকে ঘিরেই নয়, বিগত দিনগুলোতেও মসজিদ ভিত্তিক তার এই সেবা এলাকার মুরুব্বি সমাজের কাছে তাকে প্রসংশিত করে তুলেছে।
আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের বিষয়ে আলাপকালে সাহিন সিকদার বলেন, আমি কিছু পাওয়ার আসায় উন্নয়ন করিনি। জনগণের স্বার্থে করেছি। আমি নির্বাচন করবো কিনা সে বিষয়টি এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নই। কেননা আমার নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া পুরোটাই নির্ভর করছে আমার অভিভাবক জননেতা আবুল হাসান আবদুল্লাহ-এমপি ও নতুন প্রজন্মের নেতা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ’র সিদ্ধান্তের উপর। তারা আমাকে নির্বাচন করতে বললে আমি নির্বাচন করবো। আর না বললে করবো না।
এদিকে ১৬নং ওয়ার্ডে বিএনপি’র হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন মহানগর যুবলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি কামরুল হাসান রতন। যিনি গত নির্বাচনে এই ওয়ার্ড থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তৃতীয় হয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে প্রায় পাঁচ হাজার ভোটারের মধ্যে মাত্র সাড়ে ৪শ’র মত ভোট পেয়েছিলেন তিনি। তবে এবারের নির্বাচনে তার জনসমর্থন পূর্বের থেকে অনেক বেড়েছে বলে নির্বাচনে বিজয়ের বিষয়ে আশাবাদী কামরুল হাসান রতন। তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস এলাকার ভোটাররা কারোর প্রলোভনে না পড়ে আমাকেই এবার নির্বাচিত করবেন। তাছাড়া ওয়ার্ডটিতে বিএনপি’র ভোটার সংখ্যা বেশি। ওয়ার্ড বিএনপি থেকে একমাত্র প্রার্থী হিসেবে আমাকে সমর্থন দিয়েছে বলে জানিয়েছেন কামরুল হাসান রতন। রতন জানান, এলাকায় মুরুব্বি এবং তরুণ সমাজ আমাকে সমর্থন জানিয়েছে।
অপরদিকে ওয়ার্ডের অপর সম্ভাব্য প্রার্থী গোড়াচাঁদ দাস রোডের বাসিন্দা এএসএম রাফি জুয়েল। ১৬নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য ও একই ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এএসএম রাফি জুয়েল ১৬ নং ওয়ার্ডটিকে মাদক, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজ মুক্ত একটি ওয়ার্ড হিসেবে গড়ে তুলতে চান। এজন্যই নির্বাচনে আসা জানিয়ে তিনি বলেন, এক জিনিস বেশিদিন ভালো লাগে না। তাই জনগন এখন পরিবর্তন চায়। আমি আমার ওয়ার্ডটিকে সুন্দর করে সাজাতে চাই। যা একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে করা সম্ভব। সেই চিন্তা ধারা থেকেই নির্বাচনে অংশ গ্রহনের কথা জানিয়েছেন রাফি জুয়েল। একজন সফল ব্যবসায়ী রাফি জুয়েল জানান, জনগণের কল্যাণের জন্যই তার এই নির্বাচনে আসা।
এছাড়াও ১৬নং ওয়ার্ডটিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন মাওলানা মুফতি মাসউদ হাসান ফিরোজ। তিনি ইসলামী শ্রমিক আন্দোলন বরিশাল মহানগর কমিটির সহ-সভাপতি। দলীয় ভাবে তাকে ওই ওয়ার্ড থেকে নির্বাচনের জন্য মনোনিত করা হয়েছে বলে জানাগেছে।