7:03 pm , June 11, 2018

রুবেল খান ॥ বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ১৪ নং ওয়ার্ডে এবারে সম্ভাব্য প্রার্থীর সংখ্যা কমছে। গতবার যেখানে পাঁচজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে সেখানে এবার তার সংখ্যা ৪ জন। বিসিসি’র ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে একমাত্র জামায়াত নেতা কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে লড়বেন আওয়ামী লীগ ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর তিন প্রার্থী। তবে প্রতিদ্বন্দ্বি যে দলেরই হোক এবারে ওয়ার্ডটিতে আওয়ামী লীগ-জামায়াতের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে মনে করছেন ভোটাররা। এমন তথ্যই ওঠে এসেছে আজকের পরিবর্তনের ওয়ার্ড পরিক্রমায়। সরেজমিনে খোঁজ খবর নিয়ে জানাগেছে, বিসিসি’র অধীন ১৪ নং ওয়ার্ডটি এক সময় বিএনপি’র আধিপত্য ছিলো। এই ওয়ার্ডটিতে প্রথম নির্বাচিত জনপ্রিয় কাউন্সিলর ছিলেন র্যাবের সাথে ক্রসফায়ারে নিহত বিএনপি নেতা মাহবুবুল আলম মেহেদী। তার মৃত্যুর পরে ওয়ার্ডটিতে কাউন্সিলর ছিলেন তারই ভাই নাছির। ২০১৩ সালের নির্বাচনে জামায়াত নেতা এ্যাড. সালাউদ্দিন মাসুম এর কাছে পরাজিত হন। ওই নির্বাচনে চারজন প্রতিদ্বন্দ্বিকে পরাজিত করে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন মহানগর জামায়াতের সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাদক সালাউদ্দিন মাসুম। মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে জামায়াতের একমাত্র কাউন্সিলর তিনি। আসন্ন নির্বাচনেও জামায়াতের একমাত্র প্রার্থী হিসেবে ১৪নং ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানিয়েছেন সালাউদ্দিন মাসুম।
আলাপকালে তিনি জানান, গতবার ওয়ার্ডটিতে ভোটার সংখ্যা ছিলো সাড়ে পাঁচ হাজার। এর মধ্যে প্রায় দেড় হাজার ভোট পেয়ে প্রথমবারের মত কাউন্সিলর হন তিনি। তার দাবী অনুযায়ী প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীর সাথে তার ভোটের ব্যবধান ছিলো ২৭৫ ভোট। অবশ্য তার এই দাবী নিয়ে বির্তক রয়েছে।
সালাহউদ্দিন মাসুম বলেন, কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পরে এটি জান্নাতে যাবার একটি উছিলা হিসেবে গ্রহণ করেন। যে কারনে জামায়াতের রাজনীতি থেকেও অনেকটা দুরে সরে আসি। নির্বাচিত হয়ে সব কিছু ছেড়ে জনগনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছি। ওয়ার্ডের সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি ইসলাম, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কাজে সময় দিয়েছি।
তিনি বলেন, ওয়ার্ডের ২৮০ জনকে বয়স্ক ভাতা, ৩০ জনকে মাতৃত্বকালিন ভাতা ও প্রায় ৩০ জনকে প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করেছি। শুধু তাই নয়, ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে একমাত্র ১৪ নং ওয়ার্ডটিতেই পরিচ্ছন্নতা অভিযান করেছি। ওয়ার্ডের প্রায় ৮০০ বাড়িতে প্রতি বছর বিভিন্ন ফলজ ও বনজ চারা রোপন করেছি নিজ অর্থে। শুধু তাই নয়, খালেদাবাদ কলোনীর ১৩০টি পরিবারকে সেলাই মেশিন প্রদানের মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছি। বিনা খরচে ৩৬ শিশুর সুন্নতে খাতনা করে দিয়েছি।
তিনি বলেন, মৃত ব্যক্তির গোসল কিভাবে করাতে হয় তা জানা নেই অনেকের। যে কারনে মৃত ব্যক্তির গোসল করানোর জন্য এদিক ওদিক লোক খোঁজাখোঁজি করতে হয়। সেই বিষয়টি মাথায় রেখে ওয়ার্ডের ৪০ জন নারী-পুরুষকে মৃত ব্যক্তির গোসল করানোর উপরে প্রশিক্ষণ এবং তাদের সম্মানি প্রদান করেছি নিজ উদ্যোগে। ওয়ার্ডের প্রত্যেকটি ঘরে ‘মৃত্যুর পরে সন্তান ও আপনজনদের করণীয়, মৃত ব্যক্তির গোসল প্রশিক্ষণ পদ্ধতি শেখার জন্য “জবাবদিহি” নামক বই পৌঁছে দিয়েছি। যা প্রত্যেকটি মানুষের কাজে আসবে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে আমি ওয়ার্ডবাসীর আস্থা অর্জন করতে পেরেছি। বিগত নির্বাচনের পরে এটাই ছিলো আমার আসন্ন সিটি নির্বাচনের প্রস্তুতি। আরো অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে আমার ওয়ার্ডটিতে। এজন্য অন্তত আরো একবার কাউন্সিলর হওয়া জরুরী। আশাকরি জনগন বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দিন, ইসলাম ও উন্নয়নের জন্য আমাকে ভোট দিবেন।
এদিকে ১৪নং ওয়ার্ডটিতে এবারেও আওয়ামী লীগের একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। যার মধ্যে দু’জন শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকবেন বলে জানিয়েছেন। এমনকি তারা দু’জনেই দলের সমর্থন এবং সহযোগিতা’র আশা ব্যক্ত করেছেন। এরা হলেন মহানগর যুবলীগের সদস্য, ১৪নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. তৌহিদুর রহমান ছাবিদ ও মহানগর যুবলীগের সদস্য শাকিব আলম পলাশ। এদের মধ্যে শাকিব আলম পলাশ বিগত সিটি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হয়ে ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী পলাশ জামায়াত নেতা সালাহউদ্দিন মাসুম এর কাছে ১১শত ভোট পেয়ে পরাজিত হয়েছিলেন। তার দাবী গতবারের নির্বাচনে তিনিই বিজয়ী হতে। কিন্তু তার প্রাপ্ত ভোট থেকে ৭২টি ভোট বাতিল করা হয়েছিলো। যে কারনে মাত্র ৫৫ ভোটের ব্যবধানে হেরেছি। আশা করছি এবারের নির্বাচনে আমিই বিজয়ী হবো। এক্ষেত্রে নিজ বা অন্য কোন দলের প্রার্থী থাকলেও তাতে আমার কোন সমস্যা হবে না। একমাত্র জামায়াত নেতা সালাউদ্দিন মাসুমকেই প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে দেখছি।
তিনি বলেন, গত নির্বাচনে বর্তমান কাউন্সিলর সালাউদ্দিন মাসুমের ভোট ছিলো না। তিনি অন্য ওয়ার্ড থেকে জামায়াত-শিবিরের ভোট ট্রান্সফার করে এই ওয়ার্ডে এনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। যে কারনে তার সুক্ষ কৌশলের কাছে হেরে যেতে হয়েছে দাবী করে শাকিব আলম পলাশ বলেন, এবারের নির্বাচনে সেই সুযোগটি পাবেন না সালাউদ্দিন মাসুম। কেননা গত নির্বাচনের আমি পরাজিত হলেও ওয়ার্ডের উন্নয়ন এবং সামাজিক কার্যক্রম থেকে সরে যাইনি। বরং ওয়ার্ডবাসির আরো কাছে গিয়ে তাদের সেবা এবং উন্নয়নে কাজ করেছি।
তিনি বলেন, আমার ওয়ার্ডের অসহায় এবং দুস্থ শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। শিক্ষা উপকরন দেয়া থেকে শুরু করে নিজ অর্থে শিক্ষার্থীদের স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করেছি। বিনা মুল্যে চিকিৎসা সহায়তা পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন জানিয়ে শাকিব আলম পলাশ বলেন, বর্তমান কাউন্সিলর মিথ্যাচার করছেন। ওয়ার্ডবাসী তাকে পাশে পায়নি। বরং অন্যের দেয়া অনুদান এবং সেলাই মেশিন বিতরনের মাধ্যমে নিজের প্রচারনা করেছে। তিনি ওয়ার্ডবাসীর পাশে থাকেননি। গত পাঁচ বছরের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন পালিয়ে। যে কারনে সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ওয়ার্ডের জনগন।
তিনি বলেন, অনেকে অনেক কিছু বলে থাকেন। কিন্তু তার মধ্যেও আমি জয়ের ব্যপারে আশাবাদি। কেননা ওয়ার্ডে আমার সমর্থন রয়েছে। উন্নয়নের সার্থে ওয়ার্ডবাসী আমাকে চাচ্ছে। জনগনের সেবা করতেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিয়েছেন বলে বলে জানান শাকিব আলম পলাশ।
এদিকে ১৪নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিয়েছেন মহানগর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. তৌহিদুর রহমান ছাবিদ। যিনি একসময় মহানগর ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। ক্রীড়াঙ্গনের সাথে জড়িত তৌহিদুর রহমান ছাবিদ ২০১৩ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু বিসিসি’র সাবেক মেয়র প্রয়াত শওকত হোসেন হিরন’র চাপের মুখে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নির্বাচন থেকে সরে দাড়ান। তবে এবারে দলীয় সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করবেন বলে জানিয়েছেন।
বরিশাল মহানগর মানবাধিকার কমিশনের সহ-সভাপতি তৌহিদুর রহমান ছাবিদ বলেন, আমাদের ১৪নং ওয়ার্ডের মধ্যে কলোনী রয়েছে। যাদের জীবনমান উন্নয়ন হয়নি। সামান্য বৃষ্টিতে ওয়ার্ডের মানুষকে জলাবদ্ধতায় সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সব থেকে বড় বিষয় হচ্ছে ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে একমাত্র ১৪নং ওয়ার্ডেই কোন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। দু’একটি কিন্ডারগার্টেন ছাড়া অন্য বেসরকারি স্কুল-কলেজও নেই। কিন্তু ইতিপূর্বে বিষয়টি নিয়ে কোন কাউন্সিলরের মাথা ব্যাথা হয়নি। ওয়ার্ডের মধ্যে একটি ঈদগাহ রয়েছে। সেটিরও উন্নয়ন করেননি বর্তমান কাউন্সিলর। অথচ তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করছেন। এটা বর্তমান কাউন্সিলরের ব্যর্থতার একটি অংশ বলে ওয়ার্ডবাসি মনে করছেন।
তাছাড়া বর্তমান কাউন্সিলর জনগন কেন্দ্রীক কোন কাজ করেনি। তিনি ওয়ার্ডে কিছু মানুষের মাঝে সেলাই মেশিন বিতরন করেছেন। কিন্তু যাদের মেশিন দেয়া হয়েছে তা নিজের ভোট নিশ্চিত করার জন্য। অসহায় কোন মানুষ তার মাধ্যমে সহযোগিতা পায়নি। ওয়ার্ডের অধিকাংশ মানুষ আমার কাছে এসেছে সুযোগ সুবিধার জন্য। যতটুকু সামর্থ্য রয়েছে তেমনি করে সহযোগিতা করেছি। ওয়ার্ডে নিজ ব্যবস্থাপনায় আলোর ব্যবস্থা করে দিয়েছি। সুবিধা বঞ্চিত দুস্থদের ত্রান, অর্থিক সহায়তা এবং ৩৬জন শিক্ষার্থীকে নিজ অর্থে স্কুলে ভর্তি ও লেখা পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
ছাবিদ বলেন, নির্বাচিত হতে পারলে পুরো ওয়ার্ডটিকে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করার ইচ্ছা রয়েছে। বিশেষ করে এলাকার বিশাল জনগোষ্টির সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে ওয়ার্ডের মধ্যে সরকারি বেসরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন রয়েছে। ইতিপূর্বে জনপ্রতিনিধি না হয়েও ওয়ার্ডের অধিনস্ত একমাত্র খালেদাবাদ কলোনী থেকে মাদক নির্মুল করা ছাড়াও আধুনিকায়নের বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে ওয়ার্ডটিকে ঘিরে।
দলীয় সমর্থনের বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। যে কোন নাগরিক সেই অধিকার খাটাতে পারে। কিন্তু যারা ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে দলের সমর্থন চাচ্ছে তারা কতটুকু দলের হয়ে কাজ করেছে তা সবাই জানে। দলের কোন মিছিল মিটিংএ তারা ছিলেন কিনা নিজেরাও বলতে পারবে না। আবার দলের নাম ভাঙ্গিয়ে পোষ্টার, ব্যানার ছাপাচ্ছেন তাতে নিজের ছবি ছাড়া বঙ্গবন্ধু’র ছবিও ব্যবহার করছে না। তাহলে তাদের দলীয় সমর্থন আশা করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত বলে প্রশ্ন তুলে ছাবিদ বলেন, আমরা ১৪নং ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা। মানুষ আমাদের পূর্ব পুরুষ থেকে চেনেন। আমরা ভালোনা, খারাপ তা এলাকার মানুষই বলবে। আমার পরিবারে সন্ত্রাসী বা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ড করার মত কেউ নেই। অথচ যারা সুবিধা ভোগ করতে চাচ্ছে তাদের ভাইয়েরা অস্ত্র এবং মাদক নিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আটকও হয়েছে। ওয়ার্ডবাসী বিচক্ষন। তারা ভুল করবেন না। শিক্ষিত এবং গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকেই তারা ভোট দিয়ে বিজয়ী করবেন। তাই ৩০ জুলাই নির্বাচন তার (ছাবিদ) ও বর্তমান কাউন্সিলরের মধ্যেই হবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তৌহিদুর রহমান ছাবিদ।
অন্যদিকে ১৪নং ওয়ার্ডে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর হয়ে কাউন্সিলর পদে মো. শাহজাহান চৌধুরী নামের ব্যক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানা গেছে। তাকে দলীয় ভাবে ওই ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। অবশ্য নির্বাচন সামনে রেখে ওয়ার্ড কেন্দ্রিক তার প্রচার প্রচারনা’র বিষয়টি নজরে আসেনি। যে কারনে আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের প্রার্থীর মধ্যেই হাড্ডহাড্ডি লড়াই হবে বলে মনে করছেন ভোটাররা।