6:06 pm , June 4, 2018

রুবেল খান ॥ বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের অধিকাংশ ওয়ার্ডেই সম্ভাব্য কাউন্সিলর প্রার্থীরা ভোটের রাজনীতিতে নিজেদের দলীয় পরিচয় গোপন রাখছেন। তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আশা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এর ব্যতিক্রমটি ঘটছে বিসিসি’র ৭নং ওয়ার্ডে। এ ওয়ার্ডে এখন পর্যন্ত ৬ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম জানাগেছে। যারা সবাই স্ব স্ব দলের সমর্থন প্রত্যাশী। এদের মধ্যে বিএনপি সহ তিনটি দলের প্রার্থী অনেকটা চূড়ান্ত হলেও সিদ্ধান্তহীনতায় আওয়ামী লীগ। কেননা এই ওয়ার্ডটিতে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ থেকে তিনজন কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা প্রকাশ করেছেন। যারা সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থন প্রত্যাশী। এর বাইরে আওয়ামী লীগ থেকে আরো একজনের নাম শোনা যাচ্ছে। তবে তিনি নির্বাচন করবেন না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে। কিন্তু তার পরেও আওয়ামী লীগের ওই নেতাকে ঘিরেই হিসাব নিকাশ কষছেন আওয়ামী লীগের অপর তিন সম্ভাব্য প্রার্থী। তবে প্রার্থী যেই হোক, ভোটের ফলাফল ভোটারদের হাতে। বিগত দিনের হিসাব করেই প্রার্থী বেছে নিবেন তারা। আসন্ন বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে ওয়ার্ড পরিক্রমায় এমন তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। সরেজমিনে জানাগেছে, কাউনিয়া, ভাটিখানা এবং স্ব-রোড এলাকা নিয়ে গঠিত বিসিসি’র ৭নং ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডের বর্তমান ভোটার সংখ্যা ৯ হাজারের বেশি। বিগত নির্বাচনে হিসাব মতে ওয়ার্ডটিতে আওয়ামী লীগের ভোট বেশি। তার মধ্যেও ২০১৩ সালে বিসিসি’র তৃতীয় পরিষদের নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন মহানগর বিএনপি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আকবর। ওই নির্বাচনে তিনজন প্রার্থীর মধ্যে হাতি প্রতীক নিয়ে ২ হাজার ৬৩৯ ভোট পেয়ে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। তবে ভোটের পরে প্রথম কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া সৈয়দ আকবর’র কার্যক্রম নিয়ে অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েন স্থানীয় ভোটাররা। বিরোধী দলীয় নেতা হওয়ায় বছরের বেশিরভাগ সময়ে মামলা সহ বিভিন্ন কারনে তাকে থাকতে হয়েছে পালিয়ে। তাই তুলনামুলক উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হন ওয়ার্ডবাসী। রাস্তা-ঘাট, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, মশক নিধন, ময়লা আবর্জনা অপসারণে তার তদারকি ছিলো না বলে অভিযোগ কিছু কিছু ভোটারদের।
তবে ভোটারদের এমনসব অভিযোগের পাল্টা ব্যাখ্যা দিয়েছেন বর্তমান কাউন্সিলর সৈয়দ আকবর। তর মতে দীর্ঘ বছরের অবহেলিত এই ওয়ার্ডে যতটুকু উন্নয়ন হয়েছে তা গত ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যেই হয়েছে। এর পূর্বে যে উন্নয়ন হয়েছে তা ওয়ার্ড কিংবা জনগনের নয়, বরং ব্যক্তি বিশেষের উন্নয়ন হয়েছে।
কাউন্সিলর সৈয়দ আকবর বলেন, ২০১৩ সালে আমি প্রথম নির্বাচন করেছি। ওই সময় ক্ষমতায় থাকা কাউন্সিলর সহ দু’জন আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। যারা দু’জনেই পূর্বে কাউন্সিলর কিংবা কমিশনার ছিলেন। তাদের মধ্যে থেকে জনগন আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। আমি ভোটারদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তার বাস্তবায়নও করতে পেরেছি। রাস্তা, ফুটপাথ, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং অসহায় মানুষদের ভাতা প্রদান করেছি। কাউনিয়া সেকশন রোড, পান্থ সড়ক, ব্র্যাঞ্চ রোড, ভাটিখানা এবং হাতেম আলী সড়কসহ বিভিন্ন রাস্তা নির্মান করে দিয়েছি। যা ইতিপূর্বে কোন কাউন্সিলর করেনি। তাই আমি নিজেকে একজন সফল কাউন্সিলর মনে করছি।
তিনি বলেন, এখনো কিছু উন্নয়ন বাকি রয়েছে। যা করতে সময়ের প্রয়োজন। সেই অসম্পন্ন উন্নয়ন সম্পন্ন করার জন্যই আমি দ্বিতীয়বারের মত এই ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিয়েছি। এবারেও বিএনপি অনুসারী হিসেবে একমাত্র আমিই কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করছি। আমার বিশ্বাস জনগন এবারেও আমাকে ভোট দিয়ে তাদের পাশে থেকে উন্নয়নের সুযোগ করে দিবেন।
এদিকে ৭নং ওয়ার্ডটিতে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন নারী নেত্রী নিগার সুলতানা হনুফা। যিনি ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এ ওয়ার্ডে জনপ্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৯৯৫ থেকে ২০০৩ সালে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন হওয়ার পূর্বে পর্যন্ত তৎকালিন পৌর কমিশনার ছিলেন নিগার সুলতানা হনুফা। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরাজিত হন তিনি। এর পর ২০১৩ সালে পুনরায় সাধারণ কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন হনুফা। কিন্তু ওই নির্বাচনে বিএনপি নেতা সৈয়দ আকবর এর কাছে ৯৭৭ ভোটে পরাজিত হন তিনি। বৈদ্যুতিক পাখা প্রতীক নিয়ে এক হাজার ৬৬২ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন নিগার সুলতানা হনুফা। তার দাবী তৎকালিন সময় হেফাজত ইসলাম ইস্যু’র পাশাপাশি গনজাগরন মঞ্চের নেতৃত্ব দেয়ারটা তার ভোটের রাজনীতি প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি এক ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের দুই জন প্রার্থী হওয়ার কারনে ভোট ভাগ হয়ে গেছে। যে কারনে আ’লীগের কেউ নির্বাচিত হতে পারেনি। তাছাড়া পরাজয়ের পেছনে ওয়ার্ডের আদর্শ মাতৃমন্দির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে সৈয়দ আকবর’র আধিপত্য’র বিস্তার সহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন এই নারী নেত্রী।
আলাপকালে মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নিগার সুলতানা হনুফা বলেন, গত পাঁচ বছরে ওয়ার্ডে কি উন্নয়ন হয়েছে তার স্বাক্ষি জনগন। বিসিসি থেকে মাতৃত্বকালিন এবং বয়স্ক ভাতা দিয়ে থাকে। কিন্তু সেই ভাতা কারা পেয়েছে তা কেউ বলতে পারবে না। অনেকে জানেই না এ ধরনের কোন ভাতা দিয়ে থাকে বিসিসি। মশার উৎপাতে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপন ব্যাহত হচ্ছে। ছিঁচকে মাদক ব্যবসায়ীদের উপদ্রবও রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধান সহ জনগনের পাশে থেকে পুনরায় উন্নয়নের সুযোগ পেতেই আমি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিয়েছি। তবে এবারের নির্বাচনে আমি দলের মৌন সমর্থন আশা করছি। আমার বিশ্বাস সার্বিক দিক বিবেচনা করে দল আমাকে মৌন সমর্থন জানাবে। আর জণগনও আমাকে পুরনরায় তাদের সেবা করার সুযোগ দিবে বলে আমার বিশ্বাস।
এদিকে ৭নং ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের সমর্থন প্রত্যাশি তরুন নেতা ইমরুল আহমেদ উজ্জল। যিনি মহানগর যুবলীগের সদস্য ও মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। এই প্রথমবারের মত ভোটের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হচ্ছেন তিনি। ওয়ার্ডটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আশায় ২০১৩ সালে নির্বাচনের পর থেকেই ওয়ার্ডবাসীর জনকল্যানমুখি সেবায় সম্পৃক্ত হন। অংশগ্রহন করেন ওয়ার্ডকেন্দ্রিক বিভিন্ন সমাজিক কার্যক্রম এবং আন্দোলনে।
বরিশাল সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু’র ভাগ্নে ও যুবলীগ নেতা ইমরুল আহমেদ উজ্জল বলেন, আমার শিশু এবং বাল্যকাল থেকে শুরু করে জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে ৭নং ওয়ার্ডে। লেখাপড়াও করেছি এখানকার স্কুলে। তাই এই ওয়ার্ডের মানুষের সাথে আমার আত্মার সম্পর্ক রয়েছে। ওয়ার্ডবাসীর পাশে থেকে তাদের জীবন মান উন্নয়নে কাজ করার ইচ্ছা আমার। সে জন্যই বিগত নির্বাচনের পর পরই দক্ষিণাঞ্চলের রাজনৈতিক অভিভাবক আলহাজ্ব আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এমপি আমাকে ওয়ার্ড বাসীর উন্নয়নে কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন। এখন তিনি যদি নির্বাচনের অনুমতি দেন তবে ৭নং ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবো।
এদিকে ৭নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন সাবেক কাউন্সিলর আব্দুল খালেক বিশ্বাস কায়সার। যিনি ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিএনপি’র মনোনিত প্রার্থী হিসেবে ওই ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর ছিলেন। কিন্তু ২০১৩ সালের নির্বাচনে পরাজিত হন তিনি। তার এই পরাজয়ের বড় কারন হিসেবে দল পরিবর্তনকেই দায়ি করছেন সংশ্লিষ্টরা। কেননা বিএনপি’র সমর্থন নিয়ে কাউন্সিলর নির্বাচিত হলেও পরবর্তীতে সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরন’র প্রলোভনে পড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন আব্দুল খালেক বিশ্বাস কায়সার। এর ফলে ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপি এবং তাদের অনুসারীদের ভোট থেকে বঞ্চিত হন তিনি। এলাকার উন্নয়নে তার অবদান তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এসব কারনে তৎকালিন সময়ে কাউন্সিলর থাকাবস্থাতেও আব্দুল খালেক বিশ্বাস কায়সার টিউবওয়েল প্রতীক নিয়ে সর্বনি¤œ ৯৪৫ ভোট পেয়ে পরাজিত হন।
অবশ্য আব্দুল খালেক বিশ্বাস কায়সার বলেন, গত নির্বাচনে পরাজয়ের কারন ছিলো দুটি। একটি হেফাজত ইস্যু এবং অন্যটি একই দল থেকে দু’জন প্রার্থী হওয়া। তৎকালিন মেয়র দু’জনকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য বলেছেন। যে কারনে কেউ নির্বাচিত হতে পারেন নি।
তাছাড়া তিনি দাবী করে বলেন, শওকত হোসেন হিরন’র আমলে আমি কাউন্সিলর থাকাবস্থায় ৭ নং ওয়ার্ডে সার্বিক বিষয়ে ৮০ ভাগ কাজ হয়েছে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে ১০ ভাগ কাজও হয়নি। বর্তমান কাউন্সিলর সৈয়দ আকবর স্ব-শিক্ষিত। তিনি হিট লিস্টের আসামী হওয়ায় গত প্রায় পাঁচ বছরের অধিক সময় পালিয়ে ছিলো। যে কারনে এলাকার কোন উন্নয়ন হয়নি। এসব কারণেই জনগন এখন আর তাকে চায় না।
তিনি বলেন, আমি ৭নং ওয়ার্ড থেকে পুনরায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিয়েছি। তবে এবার দলের বাইরে গিয়ে কোন নির্বাচন নয়। দল যদি একমাত্র প্রার্থী হিসেবে আমাকে সমর্থন দিয়ে থাকে হবে আমি নির্বাচন করবো। আর তা না হলে করবো না।
অপরদিকে ৭নং ওয়ার্ডে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছেন চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ওই ওয়ার্ডে দলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন ইসলাম আন্দোলন বাংলাদেশ ৭নং ওয়ার্ডের সহ-সভাপতি শেখ মো. আলম। যিনি একজন ঠিকাদার।
এছাড়া কমিউনিস্ট পার্টি থেকে ওই ওয়ার্ডে অধ্যাপক পরিতোষ চন্দ্র হালদার নামে একজনকে কাউন্সিলর প্রার্থী করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির যুব ইউনিয়ন বরিশাল জেলা শাখার সম্পাদক। এ দুই প্রার্থীর মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর প্রার্থী কিছুটা আলোচনায় থাকলেও কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী বেশিরভাগ ওয়ার্ডবাসীর কাছেই অপরিচিত বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।